পুলিশ বলছে তদন্ত চলছে
খুলনার রূপসা, কয়রা ও সদর উপজেলায় গত কয়েকদিনে একাধিক অজ্ঞাত ও পরিচিত মরদেহ উদ্ধার হওয়ায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ভেসে থাকা, পচাগলা ও আঘাতের চিহ্নযুক্ত মরদেহগুলোর অধিকাংশই পুরুষ হলেও এক নারীসহ গৃহবধূর মৃত্যুও রয়েছে। পুলিশ প্রাথমিকভাবে কিছু ঘটনায় হত্যার আশঙ্কা করছে, অন্যদিকে কিছু ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলেও ধারণা করছে। তবে পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ অজানা থাকায় জনমনে আতঙ্ক ও নানা গুঞ্জন ছড়িয়েছে।
রূপসার আঠারোবেকী নদীতে অজ্ঞাত যুবকের লাশ
সোমবার (৯ জুন) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে খুলনার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়ন সংলগ্ন আঠারোবেকী নদীতে কচুরিপানার মধ্যে একটি ভাসমান মরদেহ দেখতে পান স্থানীয়রা। খবর পেয়ে রূপসা নৌ-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে। নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবুল খায়ের বলেন, মরদেহটির বয়স আনুমানিক ৩৮ থেকে ৪০ বছর হবে। গলায় একটি গভীর ক্ষতের চিহ্ন রয়েছে। তার পরনে ছিল শুধু নীল রঙের ট্রাউজার। ওপরের অংশে কোনো পোশাক ছিল না। মরদেহটি ২-৩ দিন আগের হতে পারে।
লাশ শনাক্তে সিআইডি ও পিবিআইয়ের টিম ঘটনাস্থলে আসলেও শরীরের টিস্যু পচে যাওয়ায় পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
সদর থানার মতিয়াখালী খালে অজ্ঞাত মরদেহ
বুধবার (১১ জুন) সকাল ৮টার দিকে খুলনা সদর থানাধীন মতিয়াখালী সুইচ গেট খালের মাথায় আরেকটি মরদেহ ভাসতে দেখা যায়। স্থানীয়রা জানান, মরদেহটি পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় একটি গাছের ডালে আটকে ছিল। পুলিশ ও পরে নৌ-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করে।
প্রত্যক্ষদর্শী জসিম শেখ বলেন, লাশটি দেখতে ভয়ংকর অবস্থা ছিল। শরীরের একাধিক জায়গায় চামড়া পচে গিয়েছে। নিচের অংশে ছিল কালো কাপড়, ওপরের অংশে কিছুই ছিল না। পুলিশ জানিয়েছে, মরদেহটিরও পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
কয়রায় মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর লাশ উদ্ধার
রবিবার (৮ জুন) কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাছারী বাজার সংলগ্ন একটি পুকুর থেকে নমিতা (৪০) নামের মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি কয়রার বামিয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং পেশায় ভিক্ষুক ছিলেন।
স্থানীয়দের ধারণা, পুকুরে গোসল করতে গিয়ে তিনি ডুবে যান। সাঁতার জানতেন না। কয়রা থানার অফিসার ইনচার্জ জি এম ইমদাদুল হক জানান, লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
শ্বাসরোধে গৃহবধূ হত্যা
গত রবিবার সকালে রূপসা উপজেলার আইচগাতি উত্তর পাড়ায় প্রবাসীর স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন জান্নাত (২৩)-এর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি শাওন শেখ নামে দুবাইপ্রবাসী ব্যক্তির স্ত্রী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গভীর রাতে তাকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পুলিশ প্রাথমিকভাবে এটি হত্যাকাÐ হিসেবে সন্দেহ করছে।
রূপসা থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে হত্যা সন্দেহে তদন্ত শুরু হয়েছে। মৃতের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। মরদেহ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে।
কলা বাগানে অর্ধগলিত লাশ
একই দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রূপসার শ্রীফলতলা গ্রামের দাউদ মার্কেট সংলগ্ন একটি কলা বাগান থেকে রবিউল মোল্লা (৩২) নামের এক ভ্যানচালকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি আইচগাতি ইউনিয়নের দেয়াড়া তেলির মোড় এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।
মরদেহটির শরীর ফুলে ফেঁপে গেছে এবং চামড়ায় পচন ধরেছে। তার পরনে ছিল কালো জিন্স প্যান্ট ও লাল রঙের টি-শার্ট। শরীরে ছিল একাধিক আঘাতের চিহ্ন। স্থানীয়দের ধারণা, তাকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছিল।
ওসি মাহফুজুর রহমান বলেন, মরদেহ শনাক্ত করা গেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভ্যান ছিনতাইয়ের জন্য তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
রূপসা থানার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে হত্যার আলামত থাকলেও বেশ কয়েকটি ঘটনায় অজ্ঞাত ও রহস্যজনক উপাদান রয়েছে।
নৌ-পুলিশ সূত্রে বলা হয়, নদী ও খালঘেঁষা এলাকাগুলোতে অপরাধীদের জন্য লাশ গুমের চেষ্টা করাও নতুন নয়। তবে সঠিক পরিচয় না পাওয়া পর্যন্ত তদন্তে অগ্রগতি সম্ভব নয়।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বেড়েছে। এটা উদ্বেগজনক। বিশেষ করে যেসব মরদেহের গায়ে আঘাতের চিহ্ন বা শ্বাসরোধের আলামত রয়েছে, সেগুলো আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত করছি।
এভাবে পরপর একাধিক লাশ উদ্ধারে খুলনার সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ঘটনার ছবি ও খবর ছড়িয়ে পড়ায় জনমনে প্রশ্ন উঠছে— এই মৃত্যুগুলো কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি কোনো সংগঠিত অপরাধচক্রের কাজ
নাগরিক সমাজের নেতা এড বাবুল হাওলাদার বলেন,অজ্ঞাত লাশগুলোকে ঘিরে স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া জরুরি। প্রতিটি মানুষের মৃত্যু যদি রহস্য থেকে যায়, তবে জনগণের নিরাপত্তাবোধ তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
খুলনা জেলার সা¤প্রতিক এসব লাশ উদ্ধারের ঘটনায় একদিকে যেমন পুলিশের তদন্ত চলছে, অন্যদিকে জনগণের মাঝে বাড়ছে আতঙ্ক ও নিরাপত্তা সংশয়। বিশেষ করে নদী ও খালপাড় এলাকায় গড়ে ওঠা অপরাধচক্রের বিষয়েও নজরদারি জোরদারের তাগিদ দিচ্ছেন স্থানীয়রা।