#উপকূলজুড়ে জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ #৪৫টিরও বেশি পয়েন্টে বাঁধে ফাটল
মাশরুর মুর্শেদ : পেছনে নদী, সামনে ঘর। মাঝখানে মাত্র দুই ফুট চওড়া একটি মাটির বাঁধ। তবু এটাকেই ঢাল হিসেবে ধরে নিয়ে প্রতিদিন বেঁচে থাকার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার মানুষ।
ঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের সময় চলছে। ঘড়ির কাঁটা রাত ২টা ছুঁলেই আতঙ্কে জেগে ওঠে অনেকেই। কেউ বাঁধের দিকে দৌড়ায়, কেউ বসে থাকেন রাতভর। কেননা, নদীর গর্জন হলেই মনে হয় এই বুঝি বাঁধটা ভেঙে গেল, ভেসে যাবে ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদিপশু আর সারা জীবনের সঞ্চয়।
খুলনা বিভাগের উপকূলে মোট বেড়িবাঁধ (কযঁষহধ ফরারংরড়হ – ঈড়ধংঃধষ ঊসনধহশসবহঃ চৎড়লবপঃ ধৎবধ) প্রায় ২,৬৮৫ কিলোমিটার। যার একটি বড় অংশই এখন বেশ পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাটাগরিতে পড়ে। এই বাঁধগুলো মূলত ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ‘ঈড়ধংঃধষ ঊসনধহশসবহঃ চৎড়লবপঃ (ঈঊচ)’ এর আওতায় নির্মিত হয়। এরপরে সাইক্লোন সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯), আম্পান (২০২০) ইত্যাদি দুর্যোগে বহু স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে যার আংশিক মেরামত করা হয়েছে। খুলনা ও সাতক্ষীরায় নদীঘেরা অঞ্চল বেশি হওয়ায় সেখানে বাঁধের দৈর্ঘ্যও বেশি।
বর্ষা মৌসুম এলেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে । খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় ৫২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিতে । এসব বাঁধের বেশিরভাগই জরাজীর্ণ এবং দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বারবার ভেঙে পড়ছে। চলতি বছরে তিন জেলায় ৪৫টিরও বেশি পয়েন্টে বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে এবং ২০টিরও বেশি পয়েন্টে বাঁধ সম্পূর্ণভাবে ধসে গেছে। ফলে অন্তত ৮ হাজার ৫শত পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, যার মধ্যে বহু পরিবার এখনও জলাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে। প্রায় ৩ হাজার ২শত বিঘা মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ১হাজার ৮শত একর ফসলের জমি প্লাবিত হয়েছে।
পাউবোর তথ্য মতে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় ৩৭৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩ কিলোমিটারের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৬ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায় কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৭ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
খুলনা জেলার দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া উপজেলায় বাধ রয়েছে প্রায় ১,০৩৫ কিলোমিটার । জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রয়েছে ১৬ কিলোমিটার। নতুন করে ফাটল দেখা দিয়েছে ২১টি পয়েন্টে। তার মধ্যে ভেঙ্গেছে ৭টি স্থানে । প্লাবিত হয়েছে ২০ টি গ্রাম।
পাইকগাছা, দাকোপ ও ডুমুরিয়া উপজেলার নদীতীরবর্তী ইউনিয়নগুলোর কয়েকটি স্থানে চলতি বছরে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই ভাঙনের ফলে স্থানীয় এলাকাগুলোতে প্লাবন ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে।
পাইকগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ ও শিবসা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবনের ঘটনা ঘটেছে। এতে মামুদকাটি, রাড়–লী, বোয়ালিয়া, হরিদাস কাটী, সোনাতন কাটী, মাহমুদ কাটী, গদাইপুর, গড়ইখালী ও লস্কর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, কপোতাক্ষ নদীর প্রবল জোয়ারের চাপে বোয়ালিয়ার মালোপাড়া এলাকায় বাঁধ ভেঙে শতাধিক বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে ।
দাকোপ উপজেলার পানখালী ও তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী এলাকায় ঝোপঝোপিয়া নদীর তীরে জাবেরের খেয়াট সংলগ্ন ওয়াপদা রাস্তার লক্ষীখোলা এলাকায় পিচের রাস্তার মাথায় এবং তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের ভদ্রানদীর তীরে বটবুনিয়া বাজার সংলগ্ন রাস্তায় ভাঙন দেখা দেয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানালে তিনি ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন । ডুমুরিয়া উপজেলার নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতেও বর্ষার আগেই কিছু কিছু স্থানে বেড়িবাঁধ ভাঙনের ঘটনা ঘটেছে।
উল্লেখ্য, খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৯০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে, যার অনেক অংশই দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। ফলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এসব বাঁধ ভেঙে প্লাবনের ঘটনা ঘটে ।
পাউবোর দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, উপক‚লীয় ওই তিন জেলার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ অনেকটাই সংস্কার করা হয়েছে। আরও কিছু এলাকা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায় সংস্কার বা মেরামতের প্রস্তবনা মন্ত্রনালয়ে পাঠানোর পর তা অনুমোদন হয়ে আসতে সময় লাগে। এজন্য কাজে ধীরগতি দেখা দেয়। তবে আমরা এখন বড় প্রকল্প গ্রহণ করছি যাতে টেকসই বাঁধ নির্মান করা যায়।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বার্ড-১ এর আওতায় ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩ কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২০ কিলোমিটার জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এ ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পাউবো জানিয়েছে, এই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোর মেরামত কাজ চলমান রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কলারোয়া উপজেলায় বাধ রয়েছে প্রায় ৮৬০ কিলোমিটার । জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রয়েছে ২৬ কিলোমিটার। নতুন ফাটল দেখা দিয়েছে ২৯টি পয়েন্ট টি পয়েন্টে। তার মধ্যে ভেঙ্গেছে ৬টি স্থানে । প্লাবিত হয়েছে ১৫ টি গ্রাম।
সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে একাধিক স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
আশাশুনি উপজেলায় মার্চ মাসের শুরুতে গোয়ালডাঙ্গা বাজারের ওয়াপদা বাঁধে প্রায় ৪০০ ফুট এলাকা ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে আরও ৫০০ ফুট বাঁধ ভেঙে পড়ে, ফলে বড়দল, খাজরা ও আনুলিয়া ইউনিয়নে প্লাবনের আশঙ্কা দেখা দেয় ।
এছাড়া ৩১ মার্চ আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট গ্রামে খোলপেটুয়া নদীর তীরে প্রায় ১৫০ ফুট বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করলেও জোয়ারের পানির চাপে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে, সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় রিং বাঁধ নির্মাণ ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালিত হয় ।
শ্যামনগর উপজেলায় ২৬ এপ্রিল চুনকুড়ি নদীর তীরে সিংহরতলী এলাকায় প্রায় ৩০-৩৫ মিটার বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দেয়। স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি ভিত্তিতে মেরামত কাজ শুরু করে। পরানপুর ও কাঠামারি, কৈখালী ইউনিয়নে ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পরানপুর ও কাঠামারির মাঝামাঝি এলাকায় একটি বাক্সকল ভেঙে নদীর পানি প্রবাহিত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।
বাগেরহাট জেলার মোংলা, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও রামপাল উপজেলায় বাধ রয়েছে প্রায় ৭৯০ কিলোমিটার। জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রয়েছে ১০ কিলোমিটার। নতুন ফাটল দেখা দিয়েছে ৭টির অধিক পয়েন্টে। তার মধ্যে ভেঙ্গেছে ৩টি স্থানে । প্লাবিত হয় ৫ টিরও বেশি গ্রাম।
বাগেরহাট সদর ও শরণখোলা উপজেলায় নদীর বাঁধে নতুন ফাটল ও ধস দেখা দিয়েছে। সদর উপজেলায়, ভৈরব নদীর পাড়ে পাউবোর বাঁধ ভেঙে অন্তত ৫টি গ্রামের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। শরণখোলায়, এক বছর আগে নির্মিত বাঁধেই ভাঙন দেয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ ছিল নি¤œমানের।
স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক গাজী বলেন, ঘূর্ণিঝড় এলে বাঁধ নয়, দোয়া ছাড়া কিছুই থাকে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তার মধ্যে রয়েছে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প বাগেরহাটে পাঙ্গুচি নদীর ভাঙন রোধ ও বিষখালী নদী পুনঃখনন প্রকল্প, সাতক্ষীরায় পোল্ডার নং ১৫ পুনর্বাসন প্রকল্প।
যা উপকূলীয় সুরক্ষা, নদী শাসন, বাঁধ মেরামত ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিছু এলাকায় প্রকল্পের সুফল মিললেও, অনেক স্থানে কাজের ধীরগতি, দুর্বল পরিকল্পনা এবং দুর্যোগের সময়ে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।স্থানীয় জনগণের মতে, পাউবোর প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে আরও স্বচ্ছতা ও দ্রæততা প্রয়োজন। বাঁধের দুর্বল অংশগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেরামত করা, স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ এবং দুর্যোগের সময় জরুরি প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
পরিবেশবিদ ও উপকূল গবেষক ড. নাসির উদ্দিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। একদিকে জোয়ারের উচ্চতা বাড়ছে, অন্যদিকে নদী শাসন ও ড্রেনেজ অব্যবস্থার কারণে বাঁধের ওপর চাপ বাড়ছে। কিন্তু বাঁধ ব্যবস্থাপনা এখনও ৩০ বছর আগের মডেলেই চলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে বাঁধ ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ, প্রতিটি জেলার জন্য বাঁধ ঝুঁকি ম্যাপিং ও মেরামত রোডম্যাপ তৈরিসহ স্থানীয় জনগণকে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।এছাড়া আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে টেকসই উপকূলীয় অবকাঠামোর অর্থায়ন নিশ্চিত করা।
বাঁধ শুধু মাটি নয় এটি উপকূলবাসীর জীবন, নিরাপত্তা ও অর্থনীতির প্রাচীর। প্রতি বছর দুর্যোগ আসার আগে বাঁধ ভাঙে, মানুষ ভাসে, ক্ষোভ বাড়ে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও টেকসই ভেড়ীবাঁধ নির্মাণ ছাড়া সমাধানের কোনো বিকল্প নেই।