মৃতদের পাশে প্রত্যন্ত গ্রামের কয়েকজন মানুষ
৭৯ লাশ দাফন করেও আক্রান্ত হননি কেউ

হটলাইন : ০১৯১৩-৪০৩১৭৬

এ এইচ হিমালয় ঃ করোনায় আক্রান্তদের বিষয়ে ‘অচ্ছুত’ভাব কমলেও মৃতদের দাফনে বিড়ম্বনা এখনও কমেনি। আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের শেষ গোসল ও দাফন করতে মানুষ পান না স্বজনরা। বিভিন্ন এলাকায় দাফন কার্যক্রম যারা অংশ নেন আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তারাও পাশে ভিড়তে চান না।
গত এক বছর ধরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া এমন পরিবারে পাশে দাঁড়িয়েছে খুলনার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কিছু মানুষ। আক্রান্ত হওয়ার ভয় ভুলে পরম মমতায় অন্তিম যাত্রায় মৃত ব্যক্তির পাশে থাকেন তারা। গোসল থেকে শুরু করে জানাযা ও দাফন কাজ সম্পন্ন করেন আপনজনের মতো। তাদের সংগঠনের নাম ‘দক্ষিণ ডুমুরিয়া ইমাম-ওলামা পরিষদ’। স্বেচ্ছাসেবকদের বাড়ি ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর ইউনিয়নে।
অবাক বিষয় হচ্ছে, যেই আতংকে স্বজনেরা মৃতদের পাশে থাকেন না, এ পর্যন্ত ৭৯ জনকে দাফন করলেও সংগঠনটির কেউ করোনা আক্রান্ত হননি। এমনকি জ্বর, কাশি বা অন্য কোনো উপসর্গও দেখা দেয়নি সংগঠনের ২৫ সদস্যের কারোরই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদিত বেসরকারি সংস্থার বাইরে কাজ করছে ডুমুরিয়া ইমাম-ওলামা পরিষদ। যে কারণে সরকারি কোনো সহযোগিতা পায় না সংগঠনটি। সম্পূর্ণ নিজেদের খরচেই ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী থেকে শুরু করে দাফন কাজ সম্পন্ন করতে হয় তাদের। খুলনার গ্রাম পর্যায়ের একটি সংগঠন হলেও পার্শ্ববতী গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর ও বাগেরহাট জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় মৃতদের দাফনে ছুটে যান তারা।
সংগঠনটির ২৫ সদস্যের মধ্যে ১৯ জন পুরুষ এবং ৬ জন নারী। পুরুষ সদস্যদের মধ্যে দুই জন মুহাদ্দিস, ৬ জন মাওলানা। বাকিদের মধ্যে ছাত্র, দিনমজুর ও ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন। নারীদের গোসল কার্যক্রম নারীরাই পরিচালনা করেন। পুরুষ আলেমদের স্বজনরাই নারী টিমের সদস্য।
সংগঠনের উদ্যোক্তা হাফেজ মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, গত বছর এপ্রিল মাসে সংক্রমণ শুরুর পর প্রায় ফেসবুকে দেখতাম, গোসল-জানাযা ঠিকমতো হচ্ছে না। ওই সময় গ্রামের কয়েকজন আলেম-ওলামার সঙ্গে কথা বলে দাফন টিম গঠন করি। গত বছর এপ্রিল মাসে খুলনার কয়রা উপজেলার এক ব্যক্তির দাফনের মধ্যে দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। গত ৩ জুলাই খুলনার করোনা হাসপাতালে মারা যাওয়া ফকিরহাটের এক ব্যবসায়ীর দাফনের মধ্য দিয়ে ৭৯ তম দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
নারীদের অংশগ্রহণের ঘটনা তুলে ধরে বলেন, গতবছর একরাতে খুলনা করোনা হাসপাতাল থেকে এক ব্যক্তি ফোন দিয়ে জানান, তারা মা মারা গেছেন। গোসল ছাড়াই দাফন করা যাবে কিনা। তখন পাশে আমার স্ত্রী ছিলো। আমার স্ত্রী ওই নারীর গোসল সম্পন্ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আবদুল হাই বিশ্বাসের দুই কন্যাও আমার স্ত্রীর সঙ্গে যোগ দেন। নারী টিমের সদস্য এখন ৬ জন। নারীরা কেউ মারা গেলে তারাই গোসল করান।
॥ কাজটি সহজ ছিলো না ॥
হাফেজ ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আমরা এগিয়ে আসলে দাফন কার্যক্রম কিন্তু সহজ ছিলো না। নগরীর মানিকতলা মসজিদের কোষাধ্যক্ষ মারা যাওয়ার পর আমরা গেলাম। গোসল করাতে যাব, এ সময় এলাকার মানুষ এসে গোসল করতে বাধা দিলো। আমরা মরদেহ নিয়ে যেখানেই যাই, তারাও সেখানে গিয়ে বাধা দেন। তাদের বক্তব্য এলাকার ভেতরে গোসল দেওয়া যাবে না। প্রায় ৩-৪ ঘন্টা পর একটি ড্রেনের পাশে গোসল করিয়ে দাফন করি।
আরেক দিনের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এলাকায় নিয়ে গোসল দিতে সমস্যা হয় দেখে প্রথম দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের পাশে এক ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার প্রস্তুতি নেই। মর্গে থেকে পানি এনে ড্রেনের পাশে গোসল করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি-এমন সময় পানির কল, আমাদের বালতি-মগ তালা মেরে দেয়-হাসপাতালের এক কর্মচারী। পরে রোগীর স্বজনরা বোতলজাত পানি কিনে এনে দিয়েছে। সেই পানি দিয়ে গোসল দিতে হয়েছে। দুই দিন এমন হয়েছে। অনেক জায়গা গিয়ে দেখা যায়, ঠিকমতো কবর খোঁড়া হয়নি। তখন আমাদের কবর খুঁড়ে দিতে হয়।
দাফন টিমের সদস্য আবদুল হাই বিশ্বাস আগে মাহেন্দ্র চালাতেন। তার কাছে দাফনের পরিকল্পনার কথা বলতেই তিনি রাজি হয়ে যান। এ পর্যন্ত ৭৯টি দাফনেই অংশ নিয়েছেন আবদুল হাই বিশ্বাস।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে দাফন শেষে গ্রামে গেলে সবাই বাঁকা চোখে তাকাত। এখন সবাই দোয়া করে। তবে এখনও কেউ কেউ পাশে বসতে চান না। আমি এক বেঞ্চে বসলে, তারা সরে গিয়ে অন্য জায়গায় বসে।
॥ নানা সমস্যা ॥
দাফন টিমের আরেক সদস্য শরাফপুর গ্রামের মোঃ সাব্বির মোড়ল। এইচএসসি উত্তীর্ণ বেকার সময় কাটাচ্ছেন। ফেসবুকে ওলামা পরিষদের কার্যক্রম থেকে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এ পর্যন্ত ২০টি দাফন কার্যক্রম অংশ নিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত না হওয়ায় কারও কাছ থেকেই সহযোগিতা পাওয়া যায় না। রোগীর স্বজনসহ অনেকে আমাদের পিপিই দেয়। ৭৯তম দাফনেই আমাদের সব পিপিই ও সুরক্ষা সামগ্রী শেষ। পরবর্তীতে ফোন আসলে কিভাবে সব ম্যানেজ হবে-জানি না।
আবদুল হাই বিশ্বাস বলেন, দাফন কাজে বড় সমস্যা, মৃতদের গোসলের কোনো জায়গা নেই। মেডিকেল কলেজে উন্মুক্ত স্থানে গোসল করাতে হয়। তাই আমরা টাকা দিয়ে কাপড়ের মশারি তৈরি করেছি। ৩ জন মশারি ধরে রাখেন-দুই জন গোসল করান। দুপুরে গরমের মধ্যে কাপড়ের মশারির মধ্যে পিপিই পরে গরমের সেদ্ধ হয়ে যেতে হয়। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গোসলের জন্য একটি জায়গা নির্ধারণের জন্য অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, কাজ হয়নি। একটি গোসলের জায়গা খুবই প্রয়োজন।
তিনি বলেন, আমাদের একটি যানবাহনও খুব প্রয়োজন। দাফন টিমের সবাই ডুমুরিয়ার শরাফপুর গ্রামে থাকেন। বেশিরভাগ ফোন আসে করোনা হাসপাতাল থেকে। দেখা যায়, আমরা পিপিই পরে তৈরি হয়ে মাহেন্দ্র খুঁজতে হয়। মাহেন্দ্র ভাড়া করে হাসপাতালে পৌঁছাতে হয়। তখন রোগীদের গাড়িতে করে মরদেহ নিয়ে তার বাড়িতে যেতে হয়। অনেক সময় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে যেতে হয়। মরদেহের শরীর ফুুলে যায়, দুগর্ন্ধে খুব কষ্ট হয়। এমন পরিবেশে নারীদের নিয়ে ছোটাছুটি করা খুব কষ্টকর।
॥ তারপরও তারা ছুটছেন, আক্রান্ত হননি কেউই ॥
হাফেজ ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, এতো সমস্যার মধ্যে একটি ফোনও আমরা ফিরিয়ে দেইনি। দেখা গেছে, দাফন শেষ করে গোসল করে পিপিই পোড়াচ্ছি, ঠিক তখনই আরেকটি ফোন এসেছে। আবার সবাই তৈরি হয়ে বের হয়েছি। কখনও কারও মধ্যে ক্লান্তি আসেনি। মূলত পরকালীন মুক্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সবার লক্ষ্য হওয়ায় কেউ ক্লান্ত হন না। ৭৯টি দাফন কাজে অংশ নিয়েও তাদের কারও এই পর্যন্ত জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথা বা কাশি হয়নি কারও।
॥ কাজ করছেন আরও অনেকে ॥
প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এই মানুষ ছাড়াও দাফন কার্যক্রমে এগিয়ে এসেছে আরও কিছু সংগঠন। এর মধ্যে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন অন্যতম।