মোঃ সাহেব আলী ঃ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ। জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ভাষা শহীদদের স্মরণে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হবে।
বাঙালি জাতির জন্য দিবসটি একদিকে যেমন চরম শোক ও বেদনার, অন্যদিকে মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত।
যে কোন জাতির জন্য সবচেয়ে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার হচ্ছে মৃত্যুর উত্তরাধিকার, মরতে জানা ও মরতে পারার উত্তরাধিকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদরা জাতিকে সে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন।
১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠির চোখ-রাঙ্গানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে।
মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শংকিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি সেদিন মায়ের ভাষার মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পায় নব প্রেরণা। এরই পথ বেয়ে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হয় নতুন এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ- ‘বাংলাদেশ’।
‘মোদের গরব মোদের আশা আ’মরি বাংলা ভাষা’ অতুলপ্রসাদ সেনের এই কথা প্রতিটি বাঙালীরই মনের কথা। মা, মাটি আর মুখের বোল- এই তিনে মনুষ্য জন্মের সার্থকতা। নিজের মুখের ভাষার চেয়ে মধুর আর কিছু হতে পারে না।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালীর কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাঙালীর ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাভাষা, মায়ের ভাষা, সেই মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষা আন্দোলন ও সংগ্রামের পথ দিয়েই আমরা বাঙালী, আমাদের আলাদা জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা এবং সেই সঙ্গে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন।
২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলাভাষা ব্যবহারকারী জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে বাঙালীর দেয়া রক্ত আজ বিশ্বের কাছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যা সম্ভব হয়েছে জাতির জনক ভাষাসৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের গুনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ উদ্যোগ ইতিহাস আবহমানকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ও যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার দায়িত্ব পালনের সময় (১৯৯৬-২০০১) জননেত্রী শেখ হাসিনা একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন কানাডার দুই বাঙালী প্রবাসী : রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। তবে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বেসরকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেনি। অনুরোধ/প্রস্তাব একটি সদস্য রাষ্ট্র থেকে জমা দিতে হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন, তখন খুব বেশি সময় বাকি নেই। আসলে, হাতে ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। আওয়ামী লীগ সরকার তখন প্রবাসীদের নেতৃত্বাধীন ‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’র সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং প্রস্তাবনাটি ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউনেস্কোর কাছে প্রেরণ করে। জরুরী ভিত্তিতে আমাদের মিশনগুলোকে অন্যান্য সদস্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল । পাশাপাশি এই প্রস্তাবটির জন্য তাদের সমর্থন চাওয়া হয়েছিল।
যার ফলে ’৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে প্রস্তাবটি পাস হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সালে থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালীর জাতীয় জীবনে এক গৌরবদীপ্ত ঐতিহাসিক দিন। আমাদের জাতীয় জীবনে এ দিনটির তাৎপর্য অপরিসীম। বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে অর্জিত হয়েছে বাঙালীর ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার। এ দিবসে প্রত্যেক ভাষার মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালবাসবে তেমনি অন্য জাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে। এভাবে একুশকে চেতনায় ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ।
রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন ।
খুলনার কর্মসূচী ঃ এ উপলক্ষে জাতীয় কর্মসূচির আলোকে খুলনায় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে শহিদ হাদিস পার্কে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সকল বেসরকারি ভবনে সঠিক নিয়মে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা এবং সূর্যাস্তের সাথে সাথে পতাকা নামানো হবে।
সকাল সাড়ে নয়টায় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে নগরভবনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চিত্রাংকন ও রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। বাদজোহর সকল মসজিদে শহিদদের রুহের মাগফিরাত ও দেশের শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে বিশেষ দোয়া মাহফিল এবং সুবিধামতো সময়ে মন্দির, গীর্জা ও অন্যান্য উপসনালয়ে অনুরূপ বিশেষ প্রার্থনা করা হবে।
২১ ফেব্রুয়ারি বিকাল চারটায় খুলনা বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগারে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সন্ধ্যা ছয়টায় খুলনা জেলা তথ্য অফিসের উদ্যোগে শহিদ হাদিস পার্কে ভ্রাম্যমান চলচ্চিত্র প্রদর্শন এবং একুশের পোস্টার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় খুলনা শহিদ হাদিস পার্কে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ক আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত হবে।
খুলনা সিটি কর্পোরেশন ঃ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২২ পালন উপলক্ষে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
কর্মসূচির মধ্যে দিবসের প্রথম প্রহর ১২টা ১ মিনিটে শহীদ হাদিস পার্কস্থ শহীদ মিনারে সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক-এর নেতৃত্বে পুষ্পস্তাবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নগর ভবন, মেয়রের বাস ভবন, খালিশপুর শাখা অফিস, নগর স্বাস্থ্য ভবন, মাতৃসদন, পৌর গ্যারেজ, এ্যাসফল্ট প্লান্ট, ওয়ার্ড অফিসসহ কমিউনিটি সেন্টার ও কেসিসি পরিচালিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা এবং শহীদ হাদিস পার্কসহ গুরুত্বপূর্ণ মোড়সমূহ বাংলা বর্ণমালা ও ফেস্টুন দ্বারা সজ্জিত করা হবে।
সকাল ৯টায় নগর ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক শিশুদের চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্লে থেকে নার্সারী ‘ক’ বিভাগ, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি ‘খ’ বিভাগ এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ‘গ’ বিভাগে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ‘ঘ’ বিভাগে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ এবং ৯ম ও ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ‘ঙ’ বিভাগে ‘ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশ’ বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করবেন।
খুলনা বিশ^বিদ্যালয় ঃ আজ সোমবার মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে শহিদ তাজউদ্দীন আহমেদ ভবনের সম্মুখে কালোব্যাজ ধারণ, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালোপতাকা উত্তোলন, এর পরপরই কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সকাল ১০টায় সাংবাদিক লিয়াকত আলী মিলনায়তনে আলোচনা সভা, বাদ যোহর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দোয়া মাহফিল ও কেন্দ্রীয় মন্দিরে প্রার্থনা। এছাড়াও সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হবে।
তমদ্দুন মজলিস ঃ দিবসটি উপলক্ষে বেলা ১১টায় দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
বন্ধু কিশোর কিশোরী ক্লাবঃ বন্ধু কিশোর কিশোরী ক্লাব ও রঙমহলের উদ্যোগে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সাড়ে ১০ টায় আলোচনা সভা ও বিকেল ৩টায় পথ শিশুদের নিয়ে উন্মূক্ত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছে।