খুমেক হাসপাতালে চলছে
‘চাকরী চাকরী খেলা’

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরী হয়েছিল মো: রাসেল মোল্লার। ২০ মাসের মধ্যে বেতন হয়েছে মাত্র ১০ মাসের। তাও দু’মাস দেয়া হয় নির্দিষ্ট বেতনের কম। কিছুদিন আগে যখন কর্মস্থলে গিয়ে দেখেন রোষ্টারে তার নাম নেই, তখন থেকেই মানষিক রোগী রাসেল। এভাবেই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মচারীদের সাথে চলছে চাকরী চাকরী খেলা। আর কিছু পরিবার নি:শ^ হয়ে যাচ্ছে চাকরী নামের শোনার হরিণের পেছনের দৌঁড়াতে গিয়ে। হতভাগা রাসেল মোল্লার পারিবারিক অবস্থা নিয়েই তৈরি হয়েছে আজকের প্রতিবেদন।
বাবা-মায়ের বড় সন্তান মো: রাসেল মোল্লা। অভাবের সংসার। বাবা শাহজাহান মোল্লা এক সময় ভাঙ্গারীর ব্যবসা করতেন। মা রওশন আরা বেগম বিগত ২৮ বছর ধরে ‘ফ্রি সার্ভিস’ হিসেবে কাজ করছেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাসেল মোল্লার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে বয়রার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী আর ছোট মেয়ের বয়স দু’বছর। বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রাসেল মোল্লা থাকেন খুলনা মহানগরীর বয়রাস্থ খুমেক হাসপাতালের সামনের একটি ভাড়া বাড়িতে। ছয় হাজার টাকা বাসা ভাড়াও তিন মাস বকেয় পড়েছে। করোনা মহামারীর উদ্ধুত পরিস্থিতিতে পিতা কর্মহীন। মা ‘ফ্রি সার্ভিস’ হিসেবে কাজ করতেন খুমেক হাসপাতালের বহি:বিভাগে। কিন্তু এখন তিনিও কাজ করতে অপারগ। এই যখন সংসারের অবস্থা তখন সংসারের বড় ছেলে হিসেবে অনেক আশা নিয়ে চাকরী নিয়েছিলেন আউটসোর্সিং কর্মচারী হিসেবে। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে মাছরাঙ্গা সিকিউরিটি সার্ভিসেস(প্রা:) লি: নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ পান তিনি। পদায়ন করা হয় খুমেক হাসপাতালে। ওয়ার্ড বয় পদে তার বেতন ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার ৬২০ টাকা। প্রথম মাসে হাতে হাতে বেতন পান ১৪ হাজার টাকা। দ্বিতীয় মাসে দেয়া হয় ১৫ হাজার। তৃতীয় মাস থেকে নবম মাস পর্যন্ত মোট সাত মাসের বেতন দেয়া হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। সেখানে নিয়োগপত্রের শর্ত অনুযায়ী বেতন দেয়া হলেও প্রতি মাসে নগদে ফেরত নেয়া হয় দু’হাজার ৬১০ টাকা করে। এরপর আর কোন বেতন দেয়া হয়নি রাসেল মোল্লাকে। এমনকি সম্প্রতি হাজিরা খাতা থেকেও তার নাম উধাও হয়ে যায়। কয়েক মাস পর হরিজনদের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গত সোমবার আরও এক মাসের বেতন দেয়া হয়েছে ব্যাংক হিসাবে। অর্থাৎ ২০ মাসের মধ্যে মাত্র ১০ মাসের বেতন দেয়া হয় তাকে। আবার চাকরী আছে কি না তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। এমন অবস্থায় সবকিছুই যেন এলোমেলো। মানষিক রোগীতে পরিণত হয়েছেন তিনি। এ অবস্থায় সন্তানকে নিয়ে চিন্তায় বাবা মাও।
রাসেল মোল্লার মা রওশন আরা বেগম বলেন, ১৯৯৩ সাল থেকে তিনি খুমেক হাসপাতালে ফ্রি সার্ভিস হিসেবে কাজ করেন। আশা ছিল স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে তিনি চাকরীর সুযোগ পাবেন। কিন্তু তা হয়নি। তিনি যখন ফ্রি সার্ভিস হিসেবে কাজে ঢোকেন তখন তার ছেলে রাসেল মোল্লার বয়স নয় মাস। সেই থেকে তিনি চাকরীর আশায় ঘুরছেন। রাসেলের বয়স যখন ১২ বছর তখন তাকেও ফ্রি সার্ভিস হিসেবে কাজের সুযোগ করে দেয়া হয়।
২০০৮ সালে প্রথম আউটসোর্সিং কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলে তৎকালীন এক ঠিকাদারের মাধ্যমে রাসেল চাকরীতে প্রবেশ করেন। ১৮শ’ টাকা বেতনে চাকরী শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন হয়েছিল রাসেলের। এরপর ২০১৯ সালে নতুন ঠিকাদারের মাধ্যমে আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগ করা হবে এমন প্রচারনা পেয়ে তিনি যোগাযোগের চেষ্টা করেন নতুন ঠিকাদারের সাথে। মাছরাঙ্গা সিকিউরিটি সার্ভিসেস লি: এর বয়রাস্থ অফিসে একাধিকবার গিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ফারুক হোসেন হেমায়েতের সাথে কথা বলেন। অনেক দাবি ছিল ঠিকাদারের। সর্বশেষ ধার-দেনা করে তিনি আড়াই লাখ টাকা যোগাড় করে দেন ঠিকাদারকে। টাকা না দিলে নতুন ঠিকাদার তাকে নিয়োগ দেবেন না বলেও জানানো হয়। এজন্য ঋণ নিয়ে ছেলেকে দেন আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগের জন্য নিয়োজিত ওই ঠিকাদারকে। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম দিকে এসে তার পদ পরিবর্তন হয়ে ওয়ার্ড বয় থেকে হয়ে যায় ক্লিনার। এরও ক’দিন পর রোষ্টার থেকে নাম বাদ পড়ে। প্রচার করা হয় রাসেলের চাকরী নেই। এমন প্রচারনায় রাসেল অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে বিভিন্ন মহলে ঘুরে বেড়াতে থাকেন রাসেলের পিতা-মাতা। একদিকে সংসারের অভাব অন্যদিকে ছেলে মানষিক রোগী। সব মিলিয়ে গোটা পরিবারে দেখা দেয় হতাশা।
রাসেলের মা বলেন, শোনা যাচ্ছে তার ছেলেকে বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে অন্য একজনকে নিয়োগ দিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এভাবে আরও অনেককে কয়েক মাসের ব্যবধানে চাকরীচ্যুত করে অন্য লোক নেয়া হয় টাকার বিনিময়ে। যেটিকে অমানবিক বলেও আখ্যা দেন তিনি।
রাসেলের পিতা শাহজাহান মোল্লা বলেন, তিনি নিজেও যেমন কর্মহীন তেমনি তার স্ত্রীও কাজ করতে অপারগ। বর্তমানে বড় ছেলের আয়ের ওপরই নির্ভরশীল তাদের সংসার। কিন্তু তাকে চাকরীচ্যুত করার খবরে সে নিজে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। দু’টি অবুঝ সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত তারা। ঘর ভাড়া বাকি পড়েছে তিন মাস।
রাসেল মোল্লার বিষয়টি জানার পর তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, খুমেক হাসপাতালে বিগত দু’বছর ধরে আউটসোর্সিং কর্মচারীদের নিয়ে অনেকটা ব্যবসা চলছে। প্রথমত: মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে একেক জনকে চাকরী দেয়া হয় এবং পরে কোন রকম অপছন্দ হলেই বিভিন্ন অজুহাতে তাকে বাদ দিয়ে অন্য লোককে নেয়া হয়। সেখান থেকেও গ্রহণ করা হয় অর্থ। যেটিকে কর্মচারীরা ‘চাকরী বিক্রি’ নামে অবিহিত করছেন।
এছাড়া রয়েছে রোষ্টার বাণিজ্যও। দীর্ঘদিনের প্রথা অনুযায়ী হাসপাতালের কর্মচারীদের রোষ্টার করতেন ওয়ার্ড মাষ্টার। বর্তমানে ওয়ার্ড মাষ্টারের দায়িত্ব পালন করছেন একজন কম্পিউটার অপারেটর। কিন্তু রোষ্টার করছেন হাসপাতারে একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার। সেখানেও একজন আউটসোর্সিং কর্মচারীর মাধ্যমে অন্যান্য কর্মচারীদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে সুবিধা নিয়ে পছন্দ অনুযায়ী ডিউটি বন্টন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ক্লিনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া হরিজনদের দিয়েও বহি:বিভাগের কোন কোন কক্ষের সামনে ওয়ার্ডবয়ের ডিউটি করানোর অভিযোগ আছে।
রাসেল মোল্লার চাকরী সম্পর্কে মাছরাঙ্গা সিকিউরিটি সার্ভিসেস(প্রা:) লি: এর খুমেক হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারভাইজার আব্দুর রহিম বলেন, সাবেক পরিচালকের আমলে রাসেলের বিরুদ্ধে রোগীদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগে চাকরী চলে যায়। নিয়ম অনুযায়ী একজনের চাকরী চলে গেলে অন্য একজনকে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাসেলের বেলায়ও তেমনটি হয়েছে। তার পরেও মানবিক দিক বিবেচনা করে তিনি এক মাসের বেতনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন আর তার কিছুই করার নেই।
খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা: মো: রবিউল হাসান বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে চাকরীচ্যুত করার বিষয়টি তার জানা নেই। কারও বিরুদ্ধে কাজ না করা বা অন্য কোন অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত সাপেক্ষেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা। তাছাড়া ঠিকাদার কোন কর্মচারীকে বাদ দিলেও কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে করবেন এটিই স্বাভাবিক। তার পরেও অহেতুক কাউকে হয়রানি বা চাকরীচ্যুত করা হলে তিনি বিষয়টি দেখবেন। বিশেষ করে আগামী তিন মাসের মধ্যে তিনি আউটসোর্সিং সংক্রান্ত জটিলতা দূর করে ঢেলে সাজাবেন বলেও জানান।