বিএফএফইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট
এস. হুমায়ুন কবির
# গৌরবের পদ্মা সেতু, আর বাকি ২০ দিন

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ আগামী ২৫ জুন খুলনাবাসীর জন্য হবে সৌভাগ্যময় একটি দিন। ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বার উম্মোচন হবে। মৃতপ্রায় মংলা বন্দর বিগত কয়েক বছর আগে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যেটি পদ্মাসেতু চালুর পর আরও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে। এখন আর মংলা বন্দরে জাহাজ সংকট থাকলেও চট্টগ্রামে গিয়ে শিফমেন্ট করতে বেগ পোহাতে হবে না রপ্তানীকারকদের।
এমনটি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস্ এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের(বিএফএফইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস. হুমায়ুন কবির। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে সামনে রেখে দৈনিক পূর্বাঞ্চকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি আরও বলেন, এক সময় মংলা বন্দরে জাহাজ সংকট থাকায় কন্টেইনার নিয়ে চট্টগ্রামে গিয়ে হিমায়িত খাদ্য রপ্তানীর জন্য ফেরিঘাটে বসে থাকতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। এতে সময় ও অর্থ উভয়ই নষ্ট হতো। সেই সাথে রপ্তানীযোগ্য পণ্যের গুণগত মানও নষ্ট হতো। এখন দিনে দিনেই চট্টগ্রামে গিয়ে শিফমেন্ট করে যানবাহন ফিরে আসতে পারবে। যেটি ব্যবসায়ীদের জন্য একটি সুখের খবর।
পূর্বাঞ্চলকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, পদ্মাসেতু নি:সন্দেহে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি সেতু। যেটি দীর্ঘদিনের চাহিদা থাকা সত্বেও নানাবিধ কারণে সময়মত পাওয়া যায়নি। যদি আরও ২০ বছর আগে পদ্মাসেতু হতো তাহলে নি:সন্দেহে দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতো। আজ চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক শহর বলা হয়। অথচ খুলনা ছিল এক সময় শিল্পনগরী। খুলনার শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে গেলো শুধুমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে। কিন্তু পদ্মা সেতু হলে শিল্পনগরী খুলনার সাথে বাণিজ্যিক নগরীতেও পরিণত হতো খুলনা। তবে দেরিতে হলেও আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য অনেকটা সৌভাগ্যের। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। প্রধানমন্ত্রী যে সাহস নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মানের পদক্ষেপ নিয়েছেন এজন্য তিনি প্রশংসার দাবিদার বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
পদ্মা সেতু চালু হলে মংলা, পায়রা, বেনাপোল ও ভোমরাই শুধু নয়, বরং দিনাজপুরের হিলি ও বিরল স্থল বন্দর থেকে আসা ভারতীয় মালামাল বহনেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে তিনি মনে করেন। এ ক্ষেত্রে ইউনিট হিসাব করলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে তিনি এমনভাবে বৃদ্ধির কথা ভাবছেন যা এখন ৮ হলে পদ্মা সেতু চালুর পর দাঁড়াবে ৮০তে। অর্থাৎ অনুমানের চেয়েও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। শুধু পদ্মা সেতু চালুই নয়, বরং যেদিন এর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন হয় তার পর থেকেই এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছে। অনেক জায়গার জমির দামও বেড়ে গেছে। যেটি ২৫ জুনের পর আরও বাড়বে বলে তিনি মনে করছেন।
পদ্মা সেতু চালু হলেও খুলনায় বিমান বন্দরের চাহিদা কমবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, পৃথিবীতে এখন গতির সময় চলছে। অনেক সময় দেখা যায় বিদেশী ক্রেতারা ঢাকায় নেমেই বিমানযোগে খুলনা-মংলায় আসতে চান। কারখানাগুলো পরিদর্শন করতে চান। এ ক্ষেত্রে বিমান বন্দরের সুবিধা থাকলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আনাগোনা বাড়বে। বাড়বে সুন্দরবন, খানজাহান (রহ:), ষাটগম্বুজসহ অন্যান্য প্রতœতাত্মিক নিদর্শন কেন্দ্রিক পর্যটকদের আনাগোনাও। মংলা ইপিজেডে আসবেন বিনিয়োগকারীরা। সব মিলিয়ে ফয়লার বিমান বন্দর এখনও কেন চালু হচ্ছে না সেটি নিয়েও তিনি শংকা প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে অনেকটা পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন করা হচ্ছে। শুধুমাত্র পদ্মা সেতুই পাল্টে দিতে পারে এ অঞ্চলের আরও অনেক ভৌত অবাকাঠামোগত উন্নয়ন। এজন্য দরকার রাষ্ট্রীয় সুষ্ঠু পরিকল্পনা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পাশাপাশি এসব দিকে প্রধানমন্ত্রী নজর দেবেন বলেও তিনি আশা করছেন।
পদ্মা সেতু নির্মাণের আগেই এর নির্মাণ কাজে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এটি অনেকটা দু:খজনক যে, কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। কানাডার আদালতে দায়ের করা মামলায় প্রমাণও হলো কোন দুর্নীতি হয়নি। তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হলো। তার পরেও যখন দুর্নীতি প্রমাণ হয়নি তখনও প্রধানমন্ত্রী আর ওই মন্ত্রীকে ফিরিয়ে নেননি। অর্থাৎ এদিক থেকেও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সজাগ। কেউ যাতে কোন প্রকার কথা বলতে না পারেন সেদিকেও তার দৃষ্টি ছিল।
সুতরাং পদ্মা সেতুর মধ্যদিয়ে খুলনা শিল্প নগরী আবারো তার অতীত ঐতিহ্য ফিরে পাবে এমনটি আশা করে তিনি বলেন, যেসব পাটকল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলো হয়তো আবারো চালু হবে। খুলনা নিউজপ্রিন্ট, হার্ডবোর্ড, টেক্সটাইল মিল, দাদা ম্যাচ ইত্যাদি আবারো প্রাণ ফিরে পাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। সেই সাথে নতুন নতুন আরও অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যদিয়ে খুলনাঞ্চলের অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে বলেও তিনি মনে করেন। সব পেশার লোকের আয় বাড়বে।
পদ্মা সেতুর পাশাপাশি রেল সেতু সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আপাতত: দৃষ্টিতে খুলনাবাসীকে হতাশ করেছে। কেননা, প্রাথমিকভাবে খুলনা পর্যন্ত রেল লাইনের সংযোগ না দিয়ে যশোরকে শেষ ষ্টেশন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এজন্য তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঢাকার সাথে পদ্মা রেল সেতু হয়ে খুলনার সাথে সংযোগের পরিকল্পনা নেয়ার আহবান জানান। কেননা পরিবহন ক্ষেত্রে যতই সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হওয়া যাবে ততই বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হবেন। রেলের মাধ্যমে পণ্য বহন করতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে যেমন লাভবান হওয়া যাবে তেমনি রাস্তার যানজট ও খরচ উভয় থেকেই রক্ষা পাওয়া যাবে। তাছাড়া গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্যও রেল সংযোগের বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার। পরিকল্পনাবিদদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনাও দেবেন বলে তিনি আশা করেন।
এস. হুমায়ুন কবির আরও বলেন, রাজধানী ঢাকা বা দেশের পূর্বাঞ্চলের সাথে যে বাধা ছিল পদ্মা সেতুর মাধ্যমে তা’ দূর হবে। এতে যেমন সময় বাঁচবে তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও সাশ্রয়ী হওয়া যাবে।
পদ্মাসেতুর পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য সেখানেই লোক সমাগম এটিই ব্যবসার ধর্ম। সুতরাং যখনই এখানে শিল্প গড়ে উঠবে, শহর বড় হবে তখন আশপাশের সড়কগুলো সম্প্রসারণ হওয়ার প্রয়োজন পড়বে। এজন্য তিনি নির্মাণাধীন ভৈরব সেতু দ্রুত সম্পন্ন করাসহ অন্যান্য সড়ক সম্প্রসারণ এবং খুলনা মহানগরীকে সম্প্রসারণের পাশাপাশি এর রাস্তাঘাটকে আরও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার আহবান জানান।
সর্বশেষ তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, তিনি একটি দু:সাহসকে সাহসে রূপান্তর করেছেন পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্যদিয়ে। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নে তিনি যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন তার এ অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার চিত্রে স্মরণ করবে। এর মধ্যদিয়ে একটি স্বপ্নের যেমন বাস্তবায়ন হলো তেমনি এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্নও ত্বরান্বিত হলো। ২০৪১ সাল পর্যন্ত আর অপেক্ষার প্রয়োজন হবে না, বরং পদ্মা সেতুর মাধ্যমে আর মাত্র ১০/১৫ বছরের মধ্যেই দেশ একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলেও তিনি আশা করেন।