আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এবারের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশে বেধে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে এবারের বাজেটে ভতু‌র্কির জন্য বরাদ্দ বাড়ছে। গতকাল রবিবার বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় প্রাক্কলিত বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাজেটের আকার, রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়। এবারের বাজেটের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ দশমিক ৪ শতাংশের সমান। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আগামী জুনে জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের আগে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রাথমিক প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। পরবর্তী সময়ে এর আকার কিছুটা বাড়তে পারে। এবার ভতুর্কির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে সেটি যদি বেড়ে যায় সেক্ষেত্রে বাজেটের আকারেও পরিবর্তন আসবে।বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আসছে বাজেটে কোভিড মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ, উদ্ভূত বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটজনিত কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের বাস্তবায়ন সম্পন্ন করা, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজে প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন, সারে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে স্বল্পমূল্যে ও বিনা মূল্যে খাদ্য বিতরণ, ব্যাপক কর্মসৃজনের কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার আগের অর্থবছর থেকে মাত্র ১১ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সবমিলিয়ে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল। নতুন ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য উৎস থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারি বেতন-ভাতা বাবদ ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা, পণ্য ও সেবা বাবদ ৩৮ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা, ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ৮০ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে। তাছাড়া ভতু‌র্কি প্রণোদনা ও নগদ ঋণ বাবদ ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাবদ বরাদ্দ থাকছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ২০৭ কোটি টাকা।ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ :গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৫৩ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং নগদ ঋণ খাতে বরাদ্দ থাকলেও সংশোধনের মাধ্যমে এর পরিমাণ বেড়ে হয় ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। নতুন ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে মোট বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হচ্ছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খাদ্যে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এছাড়া বিদু্যতে ১৮ হাজার কোটি টাকা, কৃষি খাতে প্রণোদনা ১৫ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি খাতে নগদ প্রণোদনা ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, পাটজাতদ্রব্যাদিতে প্রণোদনা ধরা হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং রেমিট্যান্সে প্রণোদনা ধরা হয়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ মোট ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২ দশমিক ৫৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ এবং ৩২ দশমিক ৭৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত এবছর খাদ্যশস্য সংগ্রহ হয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। তবে মূল্য সমন্বয় করা না হলে আগামী অর্থবছরে বিদু্যত্ খাতে ভতু‌র্কি বাবদ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করা না হলে এলএনজি আমদানি মূল্য পরিশোধ ও প্রণোদনা প্যাকেজের সুদ ভতু‌র্কি এবং অন্যান্য ভর্তুকির জন্য ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। সারের মূল্য সমন্বয় করা না হলে প্রয়োজন হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা।

মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর আওতায় এবার জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশ। মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে সেটি জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশের সমান। মোট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশের সমান। জিডিপির আকার দাঁড়াতে পারে ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা।বাজেটের আকার বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বাজেটের আকার মোটেও উচ্চাভিলাষী নয় বরং জিডিপির হিসাবে গতবছরের চেয়ে কমছে। যেমন গত অর্থবছরে জিডিপির সাড়ে ১৭ শতাংশ ছিল প্রস্তাবিত বাজেট। এবার জিডিপির আকার বড় হলেও শতাংশের দিক থেকে এটি ১৫ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। টাকার অঙ্কে বাড়লেও জিডিপির হিসাবে বরাদ্দ কমছে বলে তিনি মনে করেন। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকলেও এবারে বাস্তবতা বিবেচনায় গত বছরের তুলনায় মাত্র ১১ শতাংশ বৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে।