# নগরীর ভূগর্ভ থেকে প্রতিদিন ওয়াসাসহ অন্যান্য উৎসে পানি তোলা
হচ্ছে প্রায় ২২ কোটি লিটার পানি

# বিশেষজ্ঞরা বললেন, এটা চরম আত্মঘাতী

প্রকল্প নিয়ে
অনুসন্ধান-০৩

এ এইচ হিমালয় ঃ ওয়াসার আড়াই হাজার কোটি টাকার ‘খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্পের অন্যতম ছিলোÑভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরস্থ (সারফেস ওয়াটার) পানি সরবরাহ করা। একই সঙ্গে আরও ৪৫ শতাংশ নগরবাসীকে নিরাপদ পানির আওতায় আনা।
কিন্তু বিশাল ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নের পর উল্টো পথে হাঁটছে ওয়াসা। নগরবাসীকে পানিতে দিতে ভূগর্ভ থেকে প্রতিনিয়ত পানি উত্তোলন করছে সংস্থাটি। ওয়াসার হিসেবেই, প্রতিদিন সংস্থাটি আড়াই কোটি লিটার পানি তুলছে। যা মোট গ্রাহক চাহিদার ৭৪ শতাংশ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পের পানি সরবরাহের আগে ২০১৬ সালে নগরীতে ওয়াসার গ্রাহক (হোল্ডিং) ছিলো ১৯ হাজার ৫০ জন। সাধারণ একটি বাড়ি একটি হোল্ডিং হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ আগেই পানি যেত নগরীর ২৩ দশমিক ৮১ শতাংশ বাড়িতে। বর্তমানে ওয়াসার গ্রাহক ৩৭ হাজার ৩০০ জন। অর্থাৎ বিপুল কর্মযজ্ঞ শেষে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে নগরীর মাত্র ৪৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ বাসাবাড়িতে। বাকি যেসব বাড়িতে ওয়াসার সংযোগ নেই, তারা নিজেরা উৎপাদক নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভ থেকে পানি তুলছেন।
অর্থাৎ একদিকে নগরীর ৭০ ভাগ বাড়িতে বাড়িতে পানি পৌঁছে দিতে পারেনি ওয়াসা। যে ৩৭ হাজার ৩০০ বাড়িতে ওয়াসার সংযোগ রয়েছে, তাদেরও ভূগর্ভ থেকে পানি দেওয়া হচ্ছে। বাদ পড়া বাড়ির মালিকরাও ভূগর্ভ থেকে নিজেদের মতো পানি তুলছেন। পানির চাহিদা মেটানোর সব চাপ গিয়ে পড়ছে সেই ভূগর্ভেই।
॥ প্রতিদিন পানি তোলা হচ্ছে আড়াই কোটি লিটার ॥
ওয়াসার দেওয়া তথ্য বলছে, বর্তমানে নগরীতে তাদের গ্রাহক ৩৭ হাজার ৩০০ জন। তাদের পানির চাহিদা ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার লিটার। এই চাহিদার বিপরীতে ওয়াসা ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করে সরবরাহ করে আড়াই কোটি লিটার। যা’ মোট চাহিদার ৭৪ দশমিক ৬২ শতাংশ।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ৩৭ হাজার ৩০০ জন গ্রাহকের মধ্যে ওয়াসার পানি নিয়মিত ব্যবহার করে মাত্র ২০ হাজার গ্রাহক, যা নগরীর মোট হোল্ডিংয়ের মাত্র ২৫ শতাংশ। বাকি ৭৫ শতাংশ গ্রাহক বাড়িতে গভীর নলকূপ বসিয়ে বেশিরভাগ সময় ভূগর্ভ থেকে পানি তুলছেন।
খুলনা সিটি করপোরেশনের হিসেবে নগরীতে বহুতল ভবন রয়েছে প্রায় ৬০ হাজার। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ বহুতল ভবনের মালিকই ভূগর্ভ থেকে পানি তোলেন। প্রায় ১৫ লাখ জনসংখ্যার খুলনা মহানগরীতে দৈনিক ২৪ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে ওয়াসা সরবরাহ করছে প্রায় ৪ কোটি লিটার। বাকি ২০ কোটি লিটার ওয়াসার কাছ থেকে না পেয়ে বাধ্য হয়ে নগরবাসীকে তুলতে হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। আর ওয়াসা ৪ কোটি লিটারের কমপক্ষে আড়াই কোটিই এখন তুলছে ভূগর্ভ থেকে। ওয়াসা থেকে পাওয়া এই হিসাবমতে, খুলনা নগরীতেই প্রতিদিন ভূগর্ভ থেকে উঠছে ২২ কোটি লিটার পানি।
জানতে চাইলে খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘নদীর পানি পরিশোধনের খরচ প্রতি ইউনিটে (এক হাজার লিটার) প্রায় ১৮ টাকা। সম্পূর্ণ পানি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে দৈনিক যে পরিমাণ খরচ হয়, তা বহন করা ওয়াসার পক্ষে সম্ভব না। সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তা দিয়েও এই ব্যয় মেটানো যাবে না। অনেকটা বাধ্য হয়েই ভূগর্ভ থেকে পানি তুলতে হচ্ছে ওয়াসাকে।’
তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে পাওয়া ওয়াসার তথ্যে দেখা গেছে, নগরীতে ওয়াসার উৎপাদক (গভীর) নলকূপ বা পাম্প রয়েছে ৫৮টি। এর মধ্যে ৪৮টিই এখন চালু। নগরীর বেশকিছু পাম্প ঘুরে দেখেছে সমকাল। রায়ের মহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন দুই শিফটে ১৬ ঘণ্টা পানি তোলা হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। গত ৫ মে ৫৩৭ ও ৪ মে ৪৭৫ কিউবিক মিটার (এক কিউবিক মিটার = এক হাজার লিটার) পানি তোলা হয়েছে। অথচ দুই মাস আগেও পাম্প চলতো দিনে ৮ ঘণ্টা। গত ৫ ফেব্রুয়ারি এই পাম্প থেকেই ২৯২ এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ৩০০ কিউবিক মিটার পানি তোলা হয়। সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকা পুরাতন পাম্পে গিয়েও মেলে একই চিত্রÑ৫ মে পানি তোলা হয়েছে ১০৭১ কিউবিক মিটার। পাম্পটি চলেছে ১৬ ঘণ্টা।
ওয়াসা থেকে জানা গেছে, ৪৮টির মধ্যে ৮টি নলকূপ প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা এবং বাকি ৪০টি প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা করে পানি তোলে।
গত ৪ মে ভূগর্ভ থেকে ২ কোটি ৫৮ লাখ লিটার, ৩ মে ২ কোটি ৫৭ লাখ, ২ মে ২ কোটি ৪৯ লাখ লিটার এবং ১ মে ২ কোটি ৬০ লাখ লিটার পানি তুলেছে ওয়াসা। ওয়াসা যখন উৎপাদক নলকূপ দিয়ে পানি তোলে, তখন আশপাশ এলাকার নলকূপে আর পানি পাওয়া যায় না।
॥ বিশেষজ্ঞরা বললেন, এটা চরম আত্মঘাতী ॥
এই হারে পানি তোলার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুণ চৌধুরী গতকাল শনিবার পূর্বাঞ্চলকে বলেন, ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলার কারণে এ অঞ্চলের পানিস্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। ভূগর্ভেও সুপেয় পানির স্তর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে এক সময় ভূগর্ভের পানিতেও মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা চলে আসবে। এছাড়া পানিতে আর্সেনিক, আয়রনসহ মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর ধাতু বেশি মাত্রায় চলে আসবে। তখন আর সেই পানি ব্যবহার করা যাবে না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত জানালেন আরো ভয়ঙ্কর তথ্য। বললেন, একাধিক গবেষণায় তাঁরা দেখেছেন, খুলনা মহানগরীর ভূগর্ভের পানির মান বেশি ভালো না। এই পানি যতোটা কম ব্যবহার করা যায় ততোই মঙ্গল। তিনি বলেন, ‘তাছাড়া আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ভূগর্ভের গঠন ভিন্ন। এ কারণে ভূগর্ভ থেকে একবার পানি তুললে নেই পানি রিচার্জ হতে (ফের জমতে) কমপক্ষে ৬০০ থেকে ২৫ হাজার বছর পর্যন্ত সময় লাগে। ভূগর্ভের পানি যে কতো বড় সম্পদ, সেটা না বুঝেই আমরা নষ্ট করছি। এটা যে কী রকম আত্মঘাতী কাজ, তা কেউ এখন বুঝতে পারছে না।’