খুলনায় প্রথম সফল
বিরল অপারেশন

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ খুলনা মহানগরীর মিস্ত্রিপাড়া এলাকায় ওষুধের দোকান দিয়ে সংসার চলে আবু ইউসুফের। বছর তিনেক আগে একই এলাকার রওনক আরা ইভাকে বিয়ে করেন তিনি। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই পিতৃহীন। বিগত আট মাস আগে তাদের ঔরসে জন্ম নেয় একটি পুত্র সন্তান। নাম রাখা হয় জাইয়ান। কিন্তু জন্ম থেকেই নবজাতকের মাথা বড় দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন আবু ইউসুফ-ইভা দম্পতিসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা। খুলনা শিশু হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর পর পরীক্ষায় জানা গেলো নবজাতকের মাথায় পানি জমে আছে। মাথার যেসব শিরায় পানি চলাচল করে তার কোন একটি হয়তো চিকন হয়ে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য মাথা ফুলে যাচ্ছে। শিশু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তাকে নেয়া হয় নিউরো সার্জারী বিশেষজ্ঞের কাছে। খুলনার একটি প্রাইভেট হাসপাতালের একজন নিউরো সার্জনকে দেখানোর পর শিশুটির মাথায় ‘ভিপি সান্ট’ পরানোর পরামর্শ দেয়া হয়। এজন্য তার খরচ হবে ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু আরও একটু উন্নত চিকিৎসার জন্য আবু ইউসুফ তার সন্তানকে নিয়ে যান ঢাকায়। সেখানেও একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য দু’লাখ ২০ হাজার টাকা লাগবে বলে জানানো হয়। এছাড়া ঢাকায় যাতায়াত, থাকা, ওষুধুপত্র মিলিয়ে খরচের বিশালতা দেখে অনেকটা হতাশ হন আবু ইউসুফ-ইভা দম্পতি। কিন্তু সেই হতাশা অবশেষে দূর হলো খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের কারণে। ওই হাসপাতালের নিউরোসার্জারী বিভাগের কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. ইব্রাহিম খলিলের নেতৃত্বে নয় সদস্যের একটি টিম গতকাল সোমবার অপারেশন করে সফল হয়। অপারেশন শেষে ডা. ইব্রাহিম খলিল বলেন, এ ধরনের চিকিৎসা খুলনায় এই প্রথম। এটি রোগীর পরিবারের জন্য যেমন সাশ্রয়ী তেমনি চিকিৎসক হিসেবে তারও একটি সফলতা।
এ রোগের তেমন কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে ডা. ইব্রাহিম খলিল বলেন, সঠিক কোন কারণ এখনও নির্ণয় করা যায়নি। তবে অনেক সময় মায়ের ইনফেকশন থেকে যেমন এটি হতে পারে তেমনি রোগীর মাথার যেসব শিরা থেকে পানি চলাচল করে সেগুলোর কোন একটি চিকন হওয়ার ফলেও হতে পারে। তাছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে টিউমার থেকেও এমনটি হতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
অপারেশন ছাড়া এ রোগের কোন চিকিৎসা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবার পক্ষে এ রোগের চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। কেননা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান থেকে অপারেশন করাতে খরচ হয় অনেক। যেটি গরীব ও মধ্যবিত্তদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। সংশ্লিষ্ট রোগীটির বিনা খরচেই চিকিৎসা সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ রোগীর জন্য বাইরে থেকে কিছু ওষুধ কেনা ও যাতায়াত বা অন্যান্য খাতে হয়তো আট থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। যেটি অনেকের পক্ষেই বহন করা সম্ভব। এক কথায় শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে এমন চিকিৎসা সফল হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের ভরসা আরও বেড়ে গেলো বলেও তিনি মনে করেন।
এছাড়া এ রোগের চিকিৎসা আরও আধুনিক হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে এসব রোগীর ক্ষেত্রে ভিপি সান্ট করা হতো। অর্থাৎ মাথা থেকে একটি পাইপ লাগিয়ে মাথার পানি পেটের দিকে নামিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু ওই রোগীর ক্ষেত্রে তেমনটি প্রয়োজন হয়নি। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় যেটিকে ইটিভি(এন্ডোস্কপিক থার্ড ভেন্টি কোলোসটমি) বলা হয়। এর ফলেও রোগীর পরিবারের অনেকটা সাশ্রয় যেমন হয়েছে তেমনি বাড়তি ঝামেলা থেকেও রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে।
অপারেশন শেষে গতকাল রোগীকে নিউরোসার্জারী ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। সফল অপারেশন হওয়ায় রোগীর পিতা-মাতাও অনেকটা খুশি। এক কথায় আবু ইউসুফ-ইভা দম্পতির মুখে হাসি ফোটালেন আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসকরা। গতকাল দুপুরে রোগীর পিতা আবু ইউসুফ এ প্রতিবেদককে বলেন, তার আট মাসের ছেলে জাইয়ানের চিকিৎসার জন্য খুলনা-ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে অনেকটা হতাশাগ্রস্থ হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আবু নাসের হাসপাতালের আধুনিক চিকিৎসায় তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা অনেকটা আবেগ আপ্লুত। ছেলেকে কোলে পেয়ে মা রওনক আরা ইভাও অনেকটা আবেগ আপ্লুত। সব মিলিয়ে গোটা পরিবারেই দেখা গেছে আনন্দের ছাপ।
আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, জনবল ও যন্ত্রপাতির অনেকটা সংকট থাকার পরও নিউরো সার্জারী বিভাগের চিকিৎসকরা যে সফল অপারেশনটি সম্পন্ন করতে পেরেছেন এতে তাদের আত্মবিশ^াস আরও দৃঢ় হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে জনবল সংকট দূর হলে এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সরবরাহ হলে আরও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এ হাসপাতালে সম্ভব হবে।
অপারেশনে নেতৃত্ব দেয়া নিউরো সার্জন ডা. মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, অপারেশন টিমে নিউরো সার্জারী বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. নুরজাহান, এনেসথেসিয়া বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোসলেমা পারভীন ও ডা. শেখ বেল্লাল উদ্দিন, কনসালটেন্ট ডা. দিদারুল আলম ও ডা. নাঈম এবং ব্রাদার প্রকাশসহ নয় সদস্যের একটি টিম ছিল। গতকাল সকালে এ সফল অপারেশনের মধ্যদিয়ে হাসপাতালটি আরও একধাপ এগিয়ে গেলো বলেও তিনি মনে করেন।