আল কারিমের
মানব সেবা

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে ত্যাগের শিক্ষা। আর সেই ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ঈদের দিনও পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে অভুক্তদের খাবার বিতরণ করলেন খুলনার আল কারিম অক্সিজেন সেবার স্বেচ্ছাসেবকরা। পথশিশুসহ ভবঘুরেদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগ নেয়ার চেষ্টা করেন তারা। এমনকি ঈদের আগের রাতে রাস্তায়-রেল ষ্টেশন থেকে ডেকে এনে নতুন কাপড়ও দিলেন। সব মিলিয়ে ‘মানবতার সেবায় মানুষের পাশে’ এই শ্লোগান শুধু মুখে নয়, বাস্তবেই করছেন আল কারিমের সদস্যরা।
আল কারিম অক্সিজেন সেবা নামের এ সংগঠনটির যাত্রা হয়েছিল মূলত: কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেবার ব্রত নিয়ে। গত ৩ জুলাই এ সংগঠনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয়। শুরুতে মাত্র চারটি অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও তাদের কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করে অনেকেই তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। এখন তাদের সিলিন্ডারের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। হটলাইনে ফোন আসা মাত্রই আল কারিমের স্বেচ্ছাসেবকরা ছুটে যান রোগীর পাশে। দিন নেই, রাত নেই যে কোন সময় ফোন আসুক না কেন, অবিরাম ছুটে চলেন তারা। কখনও কারও বাসায়, কখনও প্রাইভেট হাসপাতালে এমনকি সরকারি হাসপাতালেও প্রয়োজন হলে রোগীদের অক্সিজেন সেবা দিচ্ছেন আল কারিম অক্সিজেন সেবার সদস্যরা।
এমনটি জানিয়ে সংগঠনের সমন্বয়কারী শেখ মো: নাসির উদ্দিন বলেন, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ যখন খুলনায় প্রকট হয়ে দেখা দেয় তখন ধীরে ধীরে মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে। অধিকাংশ মৃত্যুই অক্সিজেনের অভাবে হয় এমনটি দেখেই তারা এ সেবামূলক কর্মকান্ডটি হাতে নেন। এর পাশাপাশি রয়েছে রক্তদান কর্মসূচি এবং মৃতদের গোসল ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থাও। পুরুষ ও নারীদের সমন্বয়ে এজন্য রয়েছে পৃথক দাফন টিম।
আল কারিম অক্সিজেন সেবার সহকারী পরিচালক মুফতি মাহবুবুর রহমান বলেন, গত ৩ জুলাই থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অন্তত: চার শতাধিক মানুষকে অক্সিজেন সেবা দেয়া হয়। ২৪ ঘন্টাই তাদের টিমের সদস্যরা কাজ করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, খুলনা মহানগরীকে দু’টি জোনে ভাগ করে এ সেবা দেয়া হচ্ছে। একটি জোন খুলনা, সোনাডাঙ্গা, লবনচরা ও হরিণটানা থানা এলাকা এবং অপরটি খালিশপুর, দৌলতপুর, খানজাহান আলী ও আড়ংঘাটা থানা এলাকা নিয়ে গঠিত।
দাফন টিমের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনায় কারও মৃত্যু হলে যখন আত্মীয়-স্বজনরা পর্যন্ত কাছে যেতে চান না, তখন সেটি একটা অমানবিক বিষয় হয়ে দেখা দেয়। এজন্য আল কারিম দাফন টিমের পক্ষ থেকে যে কোন সময় যে কোন স্থানে মৃতদেহের গোসল থেকে শুরু করে দাফন পর্যন্ত তাদের টিমের সদস্যরা করে থাকেন।
নগরীর বকশীপাড়ার মীর খায়রুল ইসলাম বলেন, আল কারিম অক্সিজেন সেবা থেকে অক্সিজেন সাপোর্ট নিয়ে তার চাচীকে সেবা দেয়া হয়েছিল। পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় ঠিকই, কিন্তু আল কারিমের যে ত্বড়িৎ সেবা সেটি ভোলার নয়। এরপর যখন তার চাচীর মৃত্যু হয় তখনও পাশে ছিলেন আল কারিম দাফন টিমের নারী সদস্যরা। তারা মৃতদেহের গোসল করিয়ে দাফন উপযোগী করে তোলেন। এ ধরনের সেবার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন।
অপর সেবা গ্রহীতা নগরীর নিরালার বাসিন্দা। পিতা সরকারি চাকরীজীবী। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর আল কারিমের সেবা নেন তিনিও। সাঈদ আওসাফ প্রতীক নামের ওই সেবা গ্রহীতা একজন ছাত্র। তিনি বলেন, সম্প্রতি তার পিতা জ্বরাক্রান্ত হলে কয়েকদিন পর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এসময় আল কারিম অক্সিজেন সেবার সাথে যোগাযোগ করলে তারা দ্রুত অক্সিজেন সেবা দেন। হাসপাতালে নেয়ার আগ পর্যন্ত অক্সিজেনের সকল সাপোর্টই আল কারিম দেয়।
আল কারিমের স্বেচ্ছাসেবকদের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আজকের যুব সমাজ মাদকাসক্তের দিকে না ঝুঁকে এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত হলে সমাজ পরিবর্তন হতে পারে।
আল কারিম অক্সিজেন সেবার পরিচালক মুফতি আমানুল্লাহ বলেন, মূলত: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চরমোনাইর মরহুম পীর সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীমের নামানুসারেই আল কারিমের নামকরণ করা হয়। এর মধ্যদিয়ে অক্সিজেন সেবা, রক্তদান কর্মসূচি এবং দাফন-কাফন এ তিনটি বিষয়ে সেবা দেয়া হচ্ছে। এর বাইরেও বিগত ঈদ-উল-আযহার দিন সকালে পথশিশু ও ভবঘুরেদের মধ্যে রান্না করা সেমাই বিতরণ করা হয়েছে। দুপুরে খাওয়ানো হয়েছে গোস-ভাত। আগের রাতে তাদের মধ্যে নতুন কাপড় বিতরণ করা হয়। আল কারিমের স্বেচ্ছাসেবকরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মানুষের সেবায়। খুলনা মহানগরীতে ৫০ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবক টিম রয়েছে। প্রত্যেককে কাজ ভাগ করে দেয়া হয়েছে। কেউ অক্সিজেন রিফিলের কাজ করছেন, কেউ হটলাইনের ফোন রিসিভ করছেন, কেউ রোগীদের বাড়ি বা হাসপাতালে অক্সিজেন পৌছে দিচ্ছেন আবার কেউ রক্তদান করছেন এবং দাফন-কাফনের সাথেও কেউ কেউ সম্পৃক্ত রয়েছেন। এভাবে মানব সেবার মধ্যদিয়ে তারা ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি অর্জন করতে চান বলেও উল্লেখ করেন।
আল কারিম অক্সিজেন সেবা পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি কমিটিও। যে কমিটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মুফতি আমানুল্লাহ। সহকারী পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মুফতি মাহবুবুর রহমান, শেখ হাসান ওবায়দুল করিম ও আলহাজ্ব আব্দুল মালেক। সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শেখ মো: নাসির উদ্দিন। এছাড়া সহকারী সমন্বয়কারী মুফতি ইমরান হোসেন, বার্তা সচিব মুফতি আমিরুল ইসলাম, টিম লিডার(অক্সিজেন) গাজী ফেরদৌস সুমন, টিম লিডার(কাফন-দাফন) মো: ইমরান হোসেন মিয়া ও টিম লিডার(রক্তদান) মো: মোমিন নাসিব। এছাড়াও রয়েছে ৩০ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবক টিম।
অক্সিজেন, রক্ত বা মৃতদেহ দাফনের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে আল কারিম অক্সিজেন সেবার হট লাইনেও। নম্বরগুলো হচ্ছে- ০১৬৭৬-৫০০৩৯৫, ০১৭১১-২৪৮৩২১, ০১৭১৬-০১২২৫৫।