/ উপকূলবাসীর জীবন যেন সংগ্রামে ঘেরা

উপকূলবাসীর জীবন যেন সংগ্রামে ঘেরা

সরেজমিন কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি

এম এ হাওলাদার: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, সুন্দরবনের লাগোয়া উপকূলীয় জনপদ কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন। কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া আর আড়পাঙ্গাসিয়া নদী তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে এই ভূখন্ডকে। আকাশ থেকে দেখলে মনে হয়, পানির বুকে ভাসমান এক দ্বীপ। প্রকৃতির আশীর্বাদ নয়, বরং শাস্তির মতো প্রতিদিনের জীবনসংগ্রামই এখানের নিয়তি।

দক্ষিণ বেদকাশীতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ। নদীর জোয়ার-ভাটা আর ঘূর্ণিঝড়ের হানা এখানে জীবনের অংশ হয়ে গেছে। ২০০৯ সালের আইলার মতো দুর্যোগ মানুষকে নিঃস্ব করেছে, আবার সিডর, আমফান, ইয়াস- প্রতিটি দুর্যোগ নতুন ক্ষত তৈরি করেছে। প্রতিবারই ঘরবাড়ি ভেসে যায়, আবার নতুন করে উঠে দাঁড়াতে হয়।

মোছাঃ রফিউন নেসা নামের এক গৃহবধূর গল্প যেন গোটা উপকূলের প্রতিচ্ছবি। থাকেন দক্ষিণ বেদকাশির চরামুখার কপোতাক্ষ পাড়ের বেড়িবাঁধের ওপর। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি চার সন্তান নিয়ে বেড়িবাঁধের পাশে ঝুঁকিপূর্ণ কুঁড়েঘরে বাস শুরু করেন। সিডর, আইলা, আমফান-প্রতিটি দুর্যোগ তার সংসার ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও বারবার নতুন করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। নদীর মাছই তার পরিবারের একমাত্র ভরসা। মাছ না পেলে সন্তানদের নিয়ে কাটাতে হয় অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে। কুড়েঘরের পুরো বারান্দাজুড়ে দেখা মেলে পানিতে ভেসে আসা সুন্দরবনের বিভিন্ন ফল ও ডালপালা। জানতে চাইলে বলেন, এগুলো কুড়িয়ে শুকিয়ে রাখি সারাবছরের রান্নার জন্য। ওইগুলোই তাদের জ্বালানি।

পরিদর্শনকালে দেখা যায়, এলাকার মানুষের জীবিকার ভরসা নদী আর সুন্দরবন। মাছ, কাঁকড়া, মধু সংগ্রহ করেই চলে সংসার। কিন্তু সেখানে আবার আছে বাঘ-কুমিরের ভয়, বনবিভাগের নিয়ম, আর বনদস্যুদের দাপট। এক জেলে জানালেন, “সাত দিনের জন্য বনবিভাগকে ২৭০০ টাকা দিয়ে পাস নিতে হয়। কিন্তু বনে গেলে আবার ‘দুলাভাই বাহিনী’ কিংবা ‘ছোট জাহাঙ্গীর’, ‘বড় জাহাঙ্গীর’ বাহিনীকে ট্রিপপ্রতি চার হাজার টাকা দিতে হয়। তাদের টোকেন ছাড়া কাজ করা যায় না।” রয়েছে বাঘের আক্রমণের পর জীবন নিয়ে ফিরে আসা অনেকের গল্পও।

মোহাম্মদ শাহজাহান গাজী নামে দক্ষিণ বেদকাশীর এক বাসিন্দা জানান, “সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মাথায় গুরুতর আঘাত পাই। মাথায় ৪৮টি সেলাই লেগেছিল। এখন দিনমজুরি করেই সংসার চলে, তবে কাজও তেমন পাওয়া যায় না।”
একই এলাকার রেজাউল মোল্লা, শামসুর আলি ও কাশেম মোল্লাসহ আরও অনেকে বাঘের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। কারও জীবন গেছে, কেউ অঙ্গহানি হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন।

স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মাওলানা মাহফুজুর রহমান বলেন, “এখানে বেড়িবাঁধ মানেই জীবন। বাঁধ ভাঙলে সব ভেসে যায়, আশ্রয়কেন্দ্রও পর্যাপ্ত নেই। মানুষকে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকতে হয়।”

ওই স্কুলসহ এলাকার আরও অনেকের ভাষায় সেখানে সুপেয় পানির সংকটও মারাত্মক। সাধারণ টিউবওয়েল বছরের কয়েক মাস পানি দেয় না। যাদের সাবমারসিবল আছে তারাই কিছুটা স্বস্তিতে আছেন। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা জাগ্রত যুব সংঘ-জেজেএস কিছু বাড়িতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিকের ট্যাংক সরবরাহ করেছে। এতে কিছুটা সংকট দূর হলেও তা যথেষ্ট নয়। প্রতিটি ট্যাংকের ধারণ ক্ষমতা সাড়ে সাত হাজার লিটার। একেকটি সেটে দু’টি করে ট্যাংকি বসিয়ে মোট ১৫ হাজার লিটার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেজেএস’র সহকারী প্রকল্প সমন্বয়কারী নাজমুল হুদা। তিনি বলেন, কয়রা সদরে ১৮টি ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নে ১৮টি বাড়িতে ১৮টি সেট স্থাপন করা হয়েছে। বৃষ্টির মৌসুমে পানি ধরে রেখে যাতে পুরো বছর চালানো যায়।

দক্ষিণ বেদকাশী থেকে উপজেলা সদর ২০ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব আরও ১৩ কিলোমিটার। অর্থাৎ প্রায় ৩৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে চিকিৎসা নিতে হয় ওই ঐ এলাকার মানুষদের। ফলে গুরুতর অসুস্থরা অনেক সময় কোয়াক ডাক্তার বা গ্রাম্য চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করেন। বাঘের আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া অনেকেই স্থানীয় চিকিৎসকের সেবা নিয়েই সুস্থ হয়েছেন এমন নজিরও মিলেছে সেখানে গিয়ে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, দক্ষিণ কয়রার বেদকাশী ইউনিয়নের তিনদিক ঘেঁষা ১৪/১ নম্বর পোল্ডার পুনর্বাসনের কাজ চলছে। প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারের পাশাপাশি ব্লক বসিয়ে শক্তিশালী করা হচ্ছে। পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুর রহমান তাজকিয়া জানান, “প্রকল্পটি এ বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে। শেষ হতে আরও বছরখানেক লাগবে। এটি সম্পন্ন হলে মানুষের জীবন কিছুটা হলেও নিরাপদ হবে।”