# ডেল্টা প্লান যেন বুমেরাং না হয়

ফারুক আহমেদ ঃ ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ থেকে ১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। ১৪ শতাংশ এলাকা সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। এতে প্রায় ৩ কোটি মানুষ জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে। লবণাক্ততা ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ এলাকায় বৃদ্ধি পাবে ১ পিপিটি। ২৪ শতাংশ এলাকায় ৫ পিপিটি বৃদ্ধি পাবে। ৭০ ভাগ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ট হতে ১ মিটার উচ্চতায় হওয়ায় বন্যার আশংকাও বাড়বে ব্যাপকভাবে। বৃষ্টিপাতের তারতাম্য ঘটবে। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমবে। অন্য জায়গায় বাড়বে। এছাড়াও জলাবদ্ধতা, পলিজমা ইত্যাদি আপদগুলিতো রয়েছেই। পরিবেশ বিপর্যয়ের এই অনুসঙ্গগুলো প্রকটভাবে আবির্ভূত হওয়ার কারণে উপকূলকে এখন পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে এ তথ্য-উপাত্ত গুলি উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশকে সমন্বিতভাবে পরিবেশ সুরক্ষার আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এ উদ্যোগে রয়েছে হাজারো চ্যালেঞ্জ। পরিবেশ দূষণে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯। ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ দূষণকারী রাজধানী। ডায়িং শিল্পে ১ টন কাপড় উৎপাদনে ২০০ টন বর্জ্য যাচ্ছে নদীতে। রাসায়নিক সারের অতি ব্যবহারে এখন খাদ্যচক্র বিষাক্ত। বাতাসে, খাবারে, ফসলে সব জায়গায় বিষ। এতে লিভার, কিডনি ফুসফুস সবই বিষাক্ত। ভয়াবহ চিত্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়। এমনি বাস্তবতায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ ও জনজীবন এখন এক কঠিন বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র যমুনা নদীর পলিগঠিত ব-দ্বীপ। দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল এলাকা নিন্মভূমি। খরা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙ্গনের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয় এখানকার মানুষদের। জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল এ এলাকাকে বেশী ভোগাচ্ছে যা ২০৫০ সাল নাগাদ প্রচন্ড রূপ ধারণ করবে। হাজার বছরের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনায় মনুষ্য হস্তক্ষেপ এ বিপর্যয়ের কারণ। এটি প্রথমে শুরু হয় বৃটিশ আমল থেকে। পরবর্তীতে পাকিস্থান আমলে গত শতাব্দির ৬০-এর দশকে প্রাকৃতিক নদীব্যবস্থাপনায় নিদারুন হস্তক্ষেপ শুরু বিদেশী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোকে বেঁধে ফেলা হয় বিভিন্ন পোল্ডারে। এরপর থেকে শুরু হয় জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার উপর্যুপুরি প্রভাব। স্বাভাবিক পানি প্রবাহকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের এ নীতি উপকূলের পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের সূত্রপাত ঘটায়। এ নীতির উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে এবং এখন চলমান সকল উন্নয়ন পরিকল্পনাই পরিবেশের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ কারণে উপকূল এখন পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট ভূমির কমপক্ষে শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা উচিত। বন অধিদপ্তর বলছে, দেশের মোট ভূমির ১৭ শতাংশ বনভূমি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বনভূমির পরিমাণ ১৩ শতাংশ। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ৭ বছরে বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক তথ্য থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৬৮ হাজার একর বনভূমি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ হলো পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান বাংলাদেশের বনভূমির চিত্র।
পরিবেশ দূষণের নেতিবাচক প্রভাবে মানুষ, জীবজন্তু ও বাস্তুসংস্থানের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রকম জটিল রোগ-ব্যধিতে। জীবজন্তুর বাসস্থান বিনষ্ট হচ্ছে। খাদ্য শৃঙ্খলধ্বংস হচ্ছে। অনেক প্রাণী প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিমবাহ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সুপেয় পানির তীব্রসংকট দেখা দিচ্ছে। কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসময়ে বন্যা ও বৃষ্টির কারণে বিল ও হাওর অঞ্চলের ফসল বিনষ্ট হচ্ছে। নদীভাঙনের ফলে অনেক ফসলী জমি ও জনপদ ধ্বংস হচ্ছে।
অদূর ভবিষ্যতের পরিবেশের এ মহাবিপর্যয় রোধে ডেল্টা প্লান বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য পরিবেশ সুরক্ষা। ঝুঁকি বিবেচনায় ৬টি ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এ ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়। হটস্পটগুলির অন্যতম হচ্ছে- উপকূলীয় অঞ্চল। অন্য অঞ্চলগুলির মধ্যে রয়েছে- বরেন্দ্র ও খরাপ্রবন অঞ্চল, হাওর ও আকষ্মিক বন্যা প্রবন অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী অঞ্চল ও মোহনা, এবং নগরাঞ্চল। পানি ও জলবায়ুজনিত অভিন্ন সমস্যায় কবলিত এ অঞ্চলগুলিকে হটস্পটহিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ হটস্পটের এলাকার আয়তন ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। উপকূলীয় অঞ্চল হটস্পটগুলির অন্যতম। এ তালিকার জেলাগুলির মধ্যে রয়েছে- খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, গোপালগঞ্জ, যশোর, ঝালকাঠি, লক্ষ্মীপুর, নড়াইল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, শরিয়তপুর জেলা। উপকূলীয় এলাকা হিসেবে এ জেলাগুলির পরিবেশবা ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য খুবই স্পর্শকাতর। এ এলাকাগুলোর বেশীর ভাগই আবার ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ এলাকায় যদি অর্থনীতির সাথে পরিবেশকে সমন্বয় করা না যায় তাহলে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বুমেরাং হয়ে যাবে। তাই, অর্থনীতির চিন্তা আগে, না পরিবেশের চিন্তা আগে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগে, না নির্মল বায়ু আগে। মাথাপিছু আয় আগে না সুপেয় পানি আগে। এ বিষয়টি সময়ের বাস্তবতায় এখন খোলসা হওয়া দরকার। আসলে অর্থনীতির সাথে পরিবেশের ঠিকঠাক ‘মিথস্ত্রিয়া’ না করার কারণে ইতিমধ্যে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। মাটির উর্বরত কমেছে। মিঠা পানির উৎস নষ্ট হয়েছে। বাতাসে মাইক্রো প্লাস্টিক বাড়ছে। মৌমাছির কলোনী নষ্ট হচ্ছে। বাদুরের সংখ্যা কমছে। শকুন-ঈগল হারিয়ে গেছে। নদীর কচুরীপানাও আজকাল দেখা যায় না।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব বৃদ্ধি পেলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়। বিনিয়োগের কার্যকারিতা কমে যায়। নগরায়নের উপর চাপ বৃদ্ধি পায়। এ কারণে আবহাওয়া এবং জলবায়ুসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ঝুঁকির মধ্যে উচ্চতরএবং টেকসহ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিযোজন ব্যবস্থা অন্তরভুক্ত থাকতেহবে। তা’নাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র দূরীকরণ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন এবং ৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা লাভের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেনা। যদিও ব-দ্বীপ পরিকল্পনার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যই সেটি।
উল্লেখ্য, শত বছরের ডেল্টা প্লানের আওতায় আগামী ২০৩০ সালেরমধ্যে পাথমিক পর্যায়ে উপকূলীয় এলাকায় বাস্তবায়িত হতে পারে কমপক্ষে ৩০টি প্রকল্প। এতে ব্যয় হতে পারে ১১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। আর এ সময়ের মধ্যে সবগুলিহটস্পটে ৮০টি প্রকল্পের বিপরীতে ৩৭ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে। উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ডেল্টা প্লানের আওতায় বন্যা, নদীভাঙ্গন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যানিয়ন্ত্রণ ও নিস্কাষণ ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে ২০১৮ সালে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য টেকসই জীবন ব্যবস্থা অনেকটাই নিশ্চিত করা যাবে। এ জন্য ভবিষ্যত সরকারগুলোর রাজনৈতিক কমিটমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল।