সাধারণ মানুষের কাছে সোনার চেয়েও দামি
বাঙালির গর্ব ইলিশ মাছ। মাছটির স্বাদ জিহ্বায় জল আনে। কিন্তু সেই জাতীয় মাছটি এখন সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যদিও প্রতিবছর ইলিশ সংরক্ষণে সরকারি ভাবে ব্যবস্থা নেবার নজির রয়েছে। যার ভিতরে জাটকা নিধন বিষয়ে বিশেষ ধরনের সতর্কতা রয়েছে। তারপরেও ইলিশ মাছ সাধারণ মানুষের কাছে সোনার চেয়েও দামি বলে তা কিনতে পারছেন না।
ইলিশ উৎপাদনে বড় ভুমিকা জাটকা সংরক্ষণ। তাই জাটকা নিধন প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান রয়েছে। ‘জাটকা ধরা বন্ধ হলে, ইলিশ উঠবে জাল ভরে’ প্রতিপাদ্যে এ বছর পালিত হয় জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ইলিশকে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার কার্যকর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। ইলিশের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক অবস্থা ‘জাটকা’ রক্ষায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। তারপরেও ইলিশ সাধারণ মানুষের কাছে অধরায় থেকে যায়।
বলা হয়ে থাকে আজকের জাটকা আগামী দিনের ইলিশ। জাটকা ধরা হলে পরিপক্বতা লাভের সুযোগ বিঘ্নিত হয়ে বড় ইলিশ মিলবে। প্রাকৃতিকভাবে মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ার পর তা থেকে পোনা, পোনা থেকে জাটকা এবং পরবর্তী সময়ে বড় ইলিশে পরিণত হয়। একটি মা ইলিশ ২.৫ লাখ থেকে শুরু করে ২৩ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে অর্থাৎ একটি মা ইলিশ ধরলে ২৩ লাখ পোনা উৎপাদন বন্ধ হয়।
জাটকা ও ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরার কারণে ইলিশের উৎপাদন কমে যায়। তাই ইলিশের ভবিষ্যৎ উৎপাদন এবং জেলেদের উপার্জন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাটকা ইলিশ মাছের নতুন প্রজন্মের প্রবেশন স্তর। পরিযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী ইলিশ পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ কতকগুলো বড় নদীর উজানে গিয়ে স্রোতপ্রবাহে ডিম ছাড়ে। ভাসমান ডিম থেকে রেণু বেরিয়ে এসব এলাকায় কিছু দিন থাকে এবং এখানেই খায় ও বড় হয়। ছয় থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে পোনা দৈর্ঘ্যে ১২-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়, তখন এদের জাটকা বলে। বাংলাদেশের মৎস্য আইন অনুযায়ী, আগে জাটকার আকার ছিল ৯ ইঞ্চি। ২০১৪ সালের গেজেট সংশোধন করে ১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের (ঠোঁট থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত) কম দৈর্ঘ্যের ইলিশকে জাটকা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। মৎস্য সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এক কেজি ওজনের ইলিশ কমপক্ষে ৪০-৫০ সেন্টিমিটার এবং ২ কেজির অধিক হলে ৬০-৬২ সেন্টিমিটার হবে। জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের মাধ্যমে জাটকাকে ইলিশে রূপান্তর করা হবে।এখন ইলিশের মৌসুম তারবাজারে বড়বড় ইলিশের দেখাও মিলছে। কিন্তু দামে সেটি চোখ রাঙাচ্ছে।
বাজারে এখন এক কেজি ওজনের একটি নদীর ইলিশের দাম চাওয়া হয় আড়াই হাজার টাকা, যা সামর্থ মধ্যবিত্তের নেই। গরমকালে মধ্যম আয়ের একটি পরিবারের এক মাসের বিদ্যুৎ বিল এবং যেকোনো মৌসুমে দুই মাসের গ্যাস বিলের (মিটার ছাড়া) সমান টাকা দিয়ে কিনতে হবে একটি ইলিশ। আবার ছোট ছোট ইলিশও কেনার সুযোগ কম। ৫০০ গ্রাম আকারের নদীর (চাঁদপুর ও বরিশাল) ইলিশের প্রতি কেজির দাম সর্বনিম্ন দেড় হাজার টাকা। আর মাঝারি আকারের (৮০০ গ্রাম) এক কেজি ইলিশ কিনতে আপনাকে দিতে হবে প্রায় দুই হাজার টাকা। সাগরের ইলিশের দাম কিছুটা কম। ইলিশের এই দাম নিয়ে কথা বলেন হারুন অর রশীদ। যিনি একটি গণমাধ্যমে কাজ করেন। তিনি জানান, মাঝেমধ্যে সন্তানরা ইলিশ কেনার বাহানা ধরে। কিন্তু দাম এত বেশি যে কেনা সম্ভব হয় না। এ রকম দাম কল্পনাতীত।
যা বলছেন বিক্রেতারা:
বিক্রেতারা বলছেন, ইলিশের মৌসুম এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। কিন্তু বাজারে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। যে দাম পড়ছে, তা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মূল্যবৃদ্ধি শুধু সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়, অনেক দিন ধরেই ইলিশের দাম চড়া।মৎস্যজীবী, গবেষক ও বিক্রেতারা বলছেন, ইলিশের মূল্যবৃদ্ধির কারণ সরবরাহ কমে যাওয়া এবং চাহিদা থাকায় বাড়তি দাম আদায়ের সুযোগ। উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের নাগাল ছাড়া হয়ে গেছে জাতীয় মাছ ইলিশ। ইলিশের মূল্যবৃদ্ধির কারণ সরবরাহ কমে যাওয়া এবং চাহিদা থাকায় বাড়তি দাম আদায়ের সুযোগ। উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের নাগাল ছাড়া হয়ে গেছে জাতীয় মাছ ইলিশ।
কমেছে উৎপাদন :
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত মে মাসের ২৪ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে সাগরে মাছ ধরা। সাগর থেকে ধরা রুপালি ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা। জালে ধরা পড়া ইলিশ ট্রলার থেকে ভ্যানে তুলে তা বাজারের আনা হয়। বিগত সময়ে মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছিল। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৭ সাল থেকে ইলিশের উৎপাদন প্রথমবারের মতো ৫ লাখ মেট্রিক টন ছাড়ায়। যদিও সাম্প্রতিককালে ইলিশ উৎপাদন কমেছে। মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের নদী ও সাগরে ৫ লাখ ২৯ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষ হয়নি। হিসাবও এখনো তৈরি হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ অর্থবছরেও উৎপাদন কমবে।
দাম নিয়ে বিষ্ময় :
দেশে সারা বছরই ইলিশ ধরা পড়ে। তবে বেশি ধরা পড়ে বর্ষায়। ইলিশ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মো. আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মে ও জুন মাস থেকে একটু বেশি পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করে। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে।জুনের দ্বিতীয় ভাগে ইলিশের কেজিপ্রতি দর আড়াই হাজার টাকা হওয়াকে অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এমনিতে অনেকে বলেন তেলের দাম, জালের দাম বেড়েছে। তাই বলে ইলিশের এত বেশি দাম কোনোভাবেই যৌক্তিক না।’ইলিশ উৎপাদনে কোনো খরচ নেই। খরচ যা হয়, তা ধরার পেছনে হয়। চাষের মাছ উৎপাদনে খরচ অনেক।
তারপরও চাষের মাছের তুলনায় ইলিশের দাম বহুগুণ। যেমন বাজারে এক কেজি চাষের পাঙাশের দাম এখন ২০০ টাকার আশপাশে। ইলিশের দাম ১০ গুণের বেশি। যদিও মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ইলিশের চেয়ে পাঙাশ (৪ লাখ টন), তেলাপিয়ার (৪ লাখ ২১ হাজার টন) উৎপাদন কম। যদিও উৎপাদনের এ হিসাব নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে খুচরা পর্যায়ে ইলিশের গড় দাম ছিল ৫৯০ টাকা। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০২৩ সালে সেই দাম দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০ টাকা। ২০২৪ সালের হিসাব এখনো প্রকাশিত হয়নি। যে মাছের উৎপাদনে খরচ নেই, তার দাম এত বাড়বে কেন, জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের ইলিশ বিক্রেতা মো. কামরুল বলেন, তাদের বেশি দামে আড়তদারদের কাছ থেকে ইলিশ কিনতে হয়। কম দামে বিক্রি করার তো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ইলিশের চাহিদা আছে, কিন্তু সরবরাহ আসলে বাড়েনি।