ফারুক আহমেদ: আসলে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কতটা কষ্টের, কতটা বেদনার তা’ একমাত্র যে সন্তান হারিয়েছে, চিরদিনের মত যার প্রাণতুল্য সন্তান বিদায় নিয়েছে সে ছাড়া অন্য কারও কাছে বোধগম্য নয়। তাইতো কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার যথার্থই বিখ্যাত এই চরণটি লিখে খ্যাত হয়েছেন, ‘যতদিন ভবে, না হবে না হবে/ তোমার অবস্থা আমার সম/ ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে বুঝে না বুঝিবে/ যাতনা মম’। আসলে সন্তানের চির বিরহ যে কত কঠিন, তা’ একমাত্র ভুক্তভোগীই বুঝতে পারেন। রাজধানী উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের এত শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কষ্ট সারাদেশের মানুষকেই কাঁদাচ্ছে। যে মা তার বুকের ধনকে হারিয়েছেন তার কষ্ট, তার বুকফাটা আর্তনাদ আমরা থামাতে পারছি না। তার কষ্টে সহভাগি হলেও কষ্টের সাগর হতে তাকে বাঁচানো যাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও আমাদের সমবেদনা, আমাদের সহমর্মিতা সকল সন্তানহারা মা-বাবার প্রতিই নিবেদিত রইল।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ৪ বছরের প্রিয় সন্তান বুলবুলকে হারিয়ে লিখেছেন বিখ্যাত সে গান, ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে/ আমার গানের বুলবুলি/ করুণ চোখে চেয়ে আছে/ সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি’… একজন সন্তানহারা পিতার কি নিদারুণ কষ্ট হল এমন আবেগঘন শব্দগুলি সাজাতে পারেন। বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, যত্ন করে কাঁদানোর জন্য খুব আপন মানুষগুলোই যথেষ্ট! হূমায়ুন আহমেদ অন্য আর এক লেখায় লিখেছেন, ‘মানুষের কষ্ট দেখাও কষ্টের কাজ’। আসলেও তাই। উত্তরার ঘটনায় যে সব শিশুর প্রাণ গিয়েছে তাদের মা-বাবার, ভাই বোনের, আত্মীয়-স্বজনের কষ্ট সহ্য করার মত না। তাদের কষ্টে সারা দেশের মানুষও শোকে স্তব্ধ।
কষ্ট-দুঃখ জীবনেরই অংশ। জীবনের অন্যতম শর্তে দুঃখ কষ্টেরই সমার্থক। আবার সুখের পেছনেও দুঃখ লুকিয়ে থাকে। কষ্ট-দুঃখকে কোনভাবেই জীবন থেকে আলাদা করা যায় না। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই দুঃখ-কষ্ট নিয়েই পথ চলতে হয়। এটিই বাস্তবতা, এটিই চিরন্তন সত্য। এই সত্যের বাইরে জীবনকে নেয়া যায় না। কিন্তু তারপরও মানুষ কষ্টকে মেনে নিতে পারে না। কষ্ট মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে। কোন কোন কষ্ট মানুষ সইতেই পারে না। বিশেষ করে সন্তান হারানোর কষ্ট পিতা-মাতার জন্য পাহাড়সম বেদনার বিষয়। এতে মানুষ দিকবিদিক হয়ে যায়। জীবনের সবচেয়ে আদরের, ভালবাসার ধন যখন সে হারিয়ে ফেলে তখন চিরন্তন সত্যও তার কাছে মিথ্যা মনে হয়। জীবনের স্থাবর-অস্থাবর সব কিছুর বিনিময়ে হলেও, এমন কী নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও সে সন্তানের প্রাণ চান। এ এক অসম্ভব রকমের ভালবাসা। নাড়ির অবিচ্ছেদ্য টান। এ টান জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই দীপ্যমান থাকে। ঔজ্জ্বল্য ছড়ায় পিতা-মাতার জীবনে। তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি প্রশ্বাসে, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানের পরশ তাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের অনুভূতি।
একজন সন্তানহারা মায়ের অভিব্যক্তিতেই বোঝা যায় তার কষ্টের দীর্ঘশ্বাস কতটাই বাষ্পরুদ্র। তার মতে, ‘কেউ বুঝবে না সন্তান হারানোর ব্যথা কেমন। সারা দিনের হাসির আড়ালে বুকের ভেতরে হাহাকার করে কেঁদে উঠি’। ‘কখনো ভাবিনি এভাবে যক্ষের ধনকে এত তাড়াতাড়ি বিদায় জানাতে হবে’। আসলে সন্তানের শূণ্যতা অপূরণীয়। পৃথিবীর বিনিময়েও পূণ্যতা মিলে না। এমনি এক উপলক্ষকে সামনে রেখে কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন, এই শূন্য ঘরে, এই নির্বাসনে কতোকাল/আর কতোকাল! / আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি, উদ্যানে উঠেছে ক্যাকটাস,/ কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,/ শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি। আমরা মহান আল্লাহপাকের নিকট নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।