‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ মূল
ভবন সংরক্ষণের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের

স্টাফ রিপোর্টার ঃ ১৯০৪ সালে খুলনা নগরীর মহেশ্বরপাশা এলাকায় স্থাপন করা হয় ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ নামের অঙ্কন বিদ্যাপীঠ। বাংলাদেশের শিল্পকলায় পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী শশিভূষণ পাল যখন এটি নির্মাণ করেন তখন সে সময় পূর্ববঙ্গে আর কোনো শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই প্রায় ৪১ বছর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শশিভূষণ পাল।
এরপর কালের পরিক্রমায় বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আসা হয় নগরীর গল্লামারী এলাকায়। পরে ১৯৮৩ সালে এটি শশীভূষণ আর্ট কলেজ, পরে খুলনা আর্ট কলেজে রূপান্তরিত হয়। ২০০৯ সালে সেটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চারুকলা ইনস্টিটিউট হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আর ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ এর মূল ভবনটি শশীভূষণ শিশু বিদ্যা নিকেতন হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ভগ্নদশার কারণে ১৯২৯ সালে তৈরি বহু ইতিহাসের স্বাক্ষী বিদ্যালয়ের মূল ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
কষ্টের বিষয় হচ্ছে ইতিহাসের পাতায় সমহিমায় উজ্জ্বল এই প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষী মূল ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যালয় কমিটি। এজন্য নিলাম বিজ্ঞপ্তিতেও আহ্বান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আগ্রহীরা দরপত্র জমা দিয়েছে। স্কুল কমিটিরর এমন উদ্যোগে আন্দোলনে নেমেছেন খুলনার সংস্কৃতিপ্রেমীরা। ইতোমধ্যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ভবনটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছে।
ইতিহাসের শিক্ষক ও খুলনার অঞ্চলের ইতিহাসের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯০৪ সালে ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ প্রতিষ্ঠার পর বাংলার গভর্নর, বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতব, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পল্লিকবি জসিমউদ্দীন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী এস এম সুলতানসহ অসংখ্য গুণী ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে এসেছিলেন। জয়নুল আবেদিনও এটাকে এই বঙ্গের প্রথম শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ গল্লামারী নিয়ে আসার পর সরকারি ওই ভবনে শশীভূষণ শিশু বিদ্যা নিকেতন গড়ে তোলেন স্থানীয় সুধীজনেরা। গত প্রায় চার দশক ধরে সেখানে বিদ্যা নিকেতনের পাঠ দান চলছে। এরপর ১৯৮০ সালে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৯১ সালের দিকে সেখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে ওই কমপ্লেক্সেই তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সংস্কারের অভাবে ভবনটির ভগ্নদশা। একতলা ভবনটি চুন-সুড়কি আর ইটের গাঁথুনিতে তৈরি। লোহার পাতের ওপর মাটির টালি বসিয়ে তার ওপর ছাদ ঢালাই দেওয়া। ভবনের দেয়ালে থাকা শিলালিপিতে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, ১৯২৯ সালে বর্ধমানের মহারাজাধিরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারিভাবে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই বছরের ১৯ মে ভবনটির উদ্বোধন করেন সে সময়ের খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এইচ কুইন্টন।
খুলনা নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট নগর ভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় বিদ্যালয় ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়। ওই সভায় ভবনটি ভেঙে ফেলতে প্রধান শিক্ষক নাহিদ সুলতানার কাছে চিঠি পাঠায় কেসিসি। এরপর ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর বিদ্যালয় কমিটির এক মতবিনিময় সভায় পুরোনো ভবনটি অপসারণ করে একই আদলে নতুন একটি ভবন এবং শশীভূষণের প্রতিকৃতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম জানান, সিটি করপোরেশন থেকে ভবনটি অপসারণের চিঠি পাওয়ার পর ভবনটি অপসারণ করে এরই আদলে নতুন একটি ভবন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভবনটি নিলামে বিক্রির জন্য গত ২১ ডিসেম্বর পত্রিকায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। গত ৪ জানুয়ারি ভবনটির দরপত্র জমার শেষ দিন ছিল; মোট ছয়টি দরপত্র পড়েছে।
খুলনার ইতিহাসের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক মাজহারুল হান্নান বলেন, শশিভূষণ পালের এই স্থাপনাটি ইতিহাসের অংশ। এই ভবনটির সঙ্গে খুলনা তথা দেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জুড়ে আছে। এটি সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে সবাইকে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
॥ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সংবাদ সম্মেলন ॥
শশীভূষণ পাল প্রতিষ্ঠিত মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট এর মূল ভবনটি সংরক্ষণের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। গতকাল রোববার নগরীর উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জোটের সভাপতি হুমায়ুন কবির ববি।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, খুলনা নগরীর বয়স প্রায় দেড়শত বছর। এ নগরীতে রয়েছে ঐতিহাসিক কিছু স্মৃতিময় ইতিহাস ও তার চিহ্ন। ইতোমধ্যে খুলনার পৌর ভবন, ডাকবাংলো, পোস্ট মাস্টার জেনারেলের এর কার্যালয়সহ অনেক নকশা উন্নয়নের নামে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের মৃদু প্রতিবাদ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট এর পুরাতন ভবনটি ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, এই ভবনটি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। সে কারণে এই ভবনটি না ভেঙ্গে সংস্কারের মাধ্যমে সংরক্ষণের আহ্বান জানাই। একই সঙ্গে ভবনটি শিল্প শিল্প জাদুঘর স্থাপন করে তার সাথে সংগতি রেখে নতুন ভবনের নকশা তৈরি করে নতুন ভবন নির্মাণের দাবি জানাই।
এ দাবিতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়, প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, নগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদি চিত্রাংকন, মানববন্ধন ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক ভাস্কর শেখ সাদী ভূঞাঁ, লেখক ও শিক্ষক আবুল ফজল, জোটের সাধারণ সম্পাদক শরীফুল ইসলাম সেলিম, স্বপন গুহ, মেহেদী মুকুট, এস এম হুসাইন বিল্লাহ, দীপক দত্ত, আশরাফুল আলম রনি, শিল্পী বিধান চন্দ্র রায় ও উম্মে কুলসুম পলি প্রমুখ।