* তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে সনাকের ৭ দফা সুপারিশ

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি’র ১৬ নম্বরে রয়েছে শান্তি ও ন্যায় বিচার। এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় প্রতিটি দপ্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যম উল্লেখ করে খুলনার নাগরিক নেতারা বলছেন, সেবার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি রোধ করা, ভোটের রাজনীতি চালু করা, রাষ্ট্রের কর্মচারীদের জনগনের সেবক হিসেবে কাজ করার মানিষকতা তৈরি করা, সংবিধান অনুযায়ী জনগনকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে মূল্যায়ন করা, রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকা, দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রেও তৃণমূলকে প্রাধান্য দেয়া, অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করাসহ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা জরুরি। এজন্য অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকেও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বা এনআইএস বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। খুলনায় জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল এবং তথ্য অধিকার বাস্তবায়নসহ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় খুলনার সরকারি দপ্তরগুলো কেমন ভূমিকা রাখছে তার খন্ডচিত্র নিয়েই তৈরি হয়েছে আজকের প্রতিবেদন।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ২০০৯ সালে করা তথ্য আধিকার আইনের বাস্তবায়ন। খুলনার সরকারী দপ্তরগুলোতে এ আইনটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না বা কোন কোন ক্ষেত্রে এর ব্যাত্যয় ঘটছে তা’ বিশ্লেষনের জন্য বিগত দু’বছর ধরে খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন দপ্তর এবং জেলার চারটি উপজেলায় সচেতন নাগরিক কমিটি বা সনাকের পক্ষ থেকে জরিপ করে সরকারের কাছে একটি সুপারিশমালা পেশ করা হয়। যাতে বলা হয়, তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী নির্ধারিত ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’র নাম, পদবি, ফোন ও ই-মেইল ওয়েব পোর্টালের হোমপেজে নিয়মিত হালনাগাদ রাখা, প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বিশেষ তথ্যসমূহ (যেমন: শিক্ষা অফিসের ওয়েব পোর্টালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের নাম, ফোন, ই-মেইল সম্বলিত তালিকা) ওয়েব পোর্টালে যুক্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করা, পরিবর্তনযোগ্য তথ্যগুলো নিয়মিত হালনাগাদ রাখতে মাসে একাধিকবার ওয়েব পোর্টাল ভিজিট করার জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্দেশনা প্রদান করা, আংশিক তথ্যের পরিবর্তে প্রয়োজনীয় সকল তথ্য বিস্তারিতভাবে হালনাগাদ রাখা (যেমন: প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীর নাম ও পদবীর সাথে তাদের মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল যুক্ত করা), যে সকল প্রতিষ্ঠানের জাতীয় তথ্য বাতায়নের পোর্টাল ছাড়া স্বতন্ত্র ওয়েব সাইট রয়েছে তাদেরকে উক্ত স্বতন্ত্র ওয়েব সাইটটির লিঙ্ক জাতীয় তথ্য বাতায়নে বিদ্যমান নিজস্ব পোর্টালের হোম পেজে যুক্ত করা, ওয়েব পোর্টালকে জনগণের জন্য কার্যকর করতে জনসম্প্রচার বৃদ্ধি করা এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওয়েব পোর্টালে যুক্ত করা উচিত।
টিআইবি’র অনুপ্রেরণায় গঠিত সনাকের জরিপে দেখা যায়, খুলনা মহানগরীর ৯৬টি অফিসের মধ্যে ৫২টির ওয়েব পোর্টালে নোটিশ বোর্ড রয়েছে, ১৭টিতে রয়েছে নিজ প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত খবর, ৮৮টিতে রয়েছে অফিস প্রধানের তথ্য, ৯৩টিতে রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য, ৭৪টিতে রয়েছে সেবাসমূহের তথ্য, ৫২টিতে রয়েছে ডিও সংক্রান্ত তথ্য এবং ৭১টিতে রয়েছে যোগাযোগ সংক্রান্ত তথ্য। এর মধ্যে অবশ্য তিনটি দপ্তরের ওয়েব পোর্টালে কোন তথ্য নেই বলেও সনাকের জরিপে উল্লেখ করা হয়। যেটি ২০২১ ও ২০২২ এ দু’বছরেই দেখা গেছে। এ তিনটি সরকারি দপ্তর হলো মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কার্যালয়, জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মেট্রোপলিটন কার্যালয়। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের ব্যাপারে অবশ্য সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের প্রধান কর্তা সম্প্রতি নগরীর গোলকমনি পার্কের তথ্য মেলার স্টলে বসে এ প্রতিবেদকে বলেন, জেলা কার্যালয়টি সম্প্রতি পৃথক করা হলেও মাত্র তিনজন জনবল দিয়ে চলতে হচ্ছে।
তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ বিষয়ে সম্প্রতি খুলনার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি-শ^ায়ত্ত শাসিত দপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, অনেক অফিসেই তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তার নাম, পদবী ও যোগাযোগের ঠিকানা সম্পর্কিত কোন বোর্ড নেই। অথচ তথ্য অধিকার আইনের তৃতীয় অধ্যায়ের ১০ ধারার কয়েকটি উপ-ধারায় এ সম্পর্কে স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাকে তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়া হলেও সেখানেও কোন বোর্ড নেই। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ওয়েব পোর্টালে থাকলেও অফিসে গিয়ে কেউ কোন বোর্ড দেখেও বুঝতে পারবেন না কে সেখানের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা। এমনিভাবে খুলনার অধিকাংশ দপ্তরেই তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তার নাম, পদবী ও যোগাযোগের নম্বর স্পষ্ট করে লিখে টানানো নেই। তবে অনেকের অফিসের নিজস্ব ওয়েব পোর্টালে উল্লেখ রয়েছে প্রয়োজনীয় তথ্য। কিন্তু কোন কোন ওয়েব পোর্টাল হালনাগাদও হচ্ছে না। যদিও এ প্রসঙ্গে অনেকে বলেন, ওয়েব পোর্টাল থেকে তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তার নাম নিয়ে অনলাইনে আবেদন করার মত সক্ষমতা এখনও সকল নাগরিকের হয়নি। যে কারণে অফিসে একটি বোর্ডে এটি উল্লেখ থাকা দরকার।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন খুলনা জেলা ও বিভাগীয় সম্পাদক এবং সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক, খুলনার সভাপতি এড. কুদরত-ই-খুদা বলেন, সুশাসন একটি বড় বিষয়। রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বশেষ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সবার মধ্যেই শুদ্ধাচার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও আগে গণতান্ত্রিক চর্চা দরকার। সেই সাথে স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবিধানের পূর্ণ বাস্তবায়ন, তথ্য অধিকার আইনসহ সকল আইনের সঠিক প্রয়োগই সুশাসন দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য তিনি আমলা নির্ভরতা কমিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে তাদেরকে আরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে বলেও মত দেন। পাশাপাশি শ্রেণিভিত্তিক আইন প্রনেতা নির্বাচনের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন এই নাগরিক নেতা।
নাগরিক নেতা হিসেবে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আপনার ভূমিকা কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কথা বলা ছাড়া আর কোন শক্তি নেই। হয়তো একদিন কথা বলতে বলতেই জনগনের দাবির প্রতিফলন ঘটবে’। তবে জনকল্যানে আইন প্রনয়ন ও তার সঠিক বাস্তবায়নে আইন প্রনেতাদের আরও দক্ষ হওয়া দরকার বলেও তিনি মনে করেন। যেসব ক্ষেত্রে এখনও শব্দগত সংকট রয়েছে সেগুলো পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে সরকারি চাকরীজীবীদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে পরিচিত হওয়ার ব্যাপারেও তিনি গুরুত্বারোপ করেন। কেননা একজন সরকারি কর্মচারীর পদের সাথে যখনই ‘প্রশাসক’ শব্দটি থাকবে তখনই তার মধ্যে একটি অহমিকা চলে আসবে। এগুলোর ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া দরকার বলেও তিনি মনে করেন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, রাষ্ট্রের সংবিধান অনুসরণই হচ্ছে সুশাসনের মূল ভিত্তি। সংসদ বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ এই তিনটির সমন্বয়ে যে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে তার প্রতিটির যথাযথ বাস্তবায়নই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় সেবাদানের অফিসগুলোর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা, নিজের স্বার্থের জন্য ক্ষমতা ব্যবহার না করা, অফিস চেয়ারকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার না করা এগুলোই হচ্ছে সুশাসনের ভিত্তি। সেই সাথে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল তথা এনআইএস বাস্তবায়ন, নৈতিকা, সততা, কাজের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, ক্ষমতার অপব্যবহার না করা, সেবার খাতকে মানুষের কাছে উম্মুক্ত করা ইত্যাদি মিলেই হচ্ছে সুশাসন। এক কথায় রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীকে যেটুকু দায়িত্ব দিয়েছে তার সীমা লঙ্ঘন যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে দায়িত্ব পালনই হচ্ছে সুশাসন। তবে শুধুমাত্র জনস্বার্থে যদি কোন উদ্ভাবন হয় সেটি অবশ্য সুশাসনের জন্য সহায়ক বলেও তিনি মনে করেন।
খুলনার সরকারি দপ্তরগুলোতে সুশাসন কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল নীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে জনগনের সেবা দেয়া। চাহিত তথ্য তিনদিনের মধ্যে যাতে সরবরাহ করা যায় সে চেষ্টা করা হচ্ছে। তাছাড়া তাছাড়া সেবা গ্রহীতাদের সকলকে সমানভাবে দেখার মানষিকতা রাখার জন্যও সকলকে বলা হয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে অবহেলা বা অদক্ষতার কারনে হয়তো সেবা গ্রহীতাদের সঠিক সেবা দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা। সেদিকে লক্ষ্য রেখে সেবা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে প্রশাসন জনবান্ধব হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সবার জন্য উম্মুক্ত রাখা হচ্ছে। খুলনা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে প্রতি বুধবার গনশুনানী হচ্ছে। যার ফলে সাধারণ মানুষ যে কোন বিষয়ে সরাসরি প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলতে পারছেন। উপজেলা পর্যায়ের ভূমি অফিসগুলোতে অপেক্ষমান কক্ষ করা হয়েছে। সময়, অর্থ ও একাধিকবার দপ্তরে আসার প্রবনতা কমানোর চেষ্টা করে সেবা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
খুলনার সরকারি দপ্তরগুলোতে তথ্য অধিকার আইনের বাস্তবায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, সব দপ্তরে যাতে আইন অনুযায়ী তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকে সে ব্যাপারে উন্নয়ন সমন্বয় সভায়ও তাগিদ দেয়া হয়। এছাড়া ওয়েবসাইটেও যাতে তথ্যগুলো আপডেট থাকে সে সম্পর্কেও জোর দেয়া হয়। তবে তথ্য অধিকার আইনের আলোকে কিছু লোকের অদ্ভুত প্রশ্ন অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। যেসব প্রশ্নের সাথে সংশ্লিষ্ট অফিসের কোন সংশ্লিষ্টতাই নেই সে ধরনের প্রশ্ন করায় অনেক সময় হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়। এজন্য জনগনকেও আরও সচেতন হওয়ার আহবান জানান তিনি। এক কথায় সেবা দাতা ও সেবা গ্রহীতা উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নসহ সুশাসন বাস্তবায়ন সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন।