* তদন্ত কমিটি গঠন, ময়না তদন্ত ছাড়া লাশ দাফন কিনা সিদ্ধান্ত আজ

স্টাফ রিপোর্টার ঃ প্রায় ৩০ বছর আগের পুরাতন দেয়ালে ছিল না কোন আরসিসি পিলার। শুধুমাত্র মাঝে মধ্যে ১০ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনি দিয়েই পাঁচ ইঞ্চির এ বিশাল সীমানা দেয়ালটি হয়েছিল। দেয়ালটি পুরাতন হওয়ায় সম্প্রতি একাংশ হেলেও পড়ে। যা ছিল অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু সেটি ভেঙ্গে নতুন করে না তৈরি করে আবারো তার ওপর প্রলেপ দেয়া শুরু করেছিল ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানী কর্তৃপক্ষ। আর ওই দেয়ালের পাশে খেলা করতে করতেই ভেঙ্গে পড়ে নিহত হলো মাত্র সাত বছরের শিশু তামিম। একই ঘটনায় ১০ বছর বয়সী ইয়ামি হাওলাদার ও ১১ বছরের গোলাম রাব্বী আহত হয়ে বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছে।
হৃদয় বিদারক এ ঘটনাটি ঘটে গতকাল শুক্রবার সকালে নগরীর সোনাডাঙ্গা মডেল থানাধীন করিম নগরস্থ ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানীর প্রধান কার্যালয়ে। ওজোপাডিকোর বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৪এর আওতায় দেয়াল সংস্কারের এ কাজটি করছিল পলাশ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। চা দোকান দিয়ে সংসার চালানো মিঠু আকন্দের তিন সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলে তামিমের এমন মৃত্যুতে তিনি ভয়ানক শোকাহত হন। গতকাল সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা যায় তিনি বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। আর এরই মধ্যে পরিবারের সদস্যদের আবেগের সুযোগে স্থানীয় একটি মহলের সাথে সমঝোতার নামে দ্রুত নিহত শিশুটিকে দাফনের চেষ্টা করা হয়। যেটি নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। কেউ কেউ বলছেন, ময়না তদন্ত ছাড়া শিশুটিকে দাফন দিতে পারলেই পরবর্তীতে এ বিষয়ে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকবে না। এজন্য দ্রুত তাকে দাফনের ব্যবস্থা করা হয় এবং ওজোপাডিকোর পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা এবং তার পিতা মিঠু আকন্দকে ওজোপাডিকোতে চাকরী দেয়া হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। পরে রাতে এলাকাবাসী সিদ্ধান্ত নেন, আজ শনিবার সকালে ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে শিশুটিকে ময়না তদন্ত ছাড়া দাফনের জন্য গতকাল রাতেই জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাখা হয়েছে।
কেএমপির সোনাডাঙ্গা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মমতাজুল হক বলেন, ওজোপাডিকো’র সদর দপ্তরের পেছন দিকের দেওয়াল জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়ায় তা’ সংস্কার করার জন্য সম্প্রতি দেয়ালের দু’পাশের প্লাস্টার খুলে ফেলা হয়। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ দেয়ালের প্রায় একশ’ ফুট হেলে পড়ে তামিমসহ তিন শিশু আহত হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তামিমের মৃত্যু হলেও অপর দু’শিশু খুমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এছাড়া নিহত শিশু তামিমের লাশ গতরাতে খুমেক হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, ঘটনার পর তারা শিশু তিনটিকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখান থেকে দুপুরে তামিমকে নগরীর সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেও ওই শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় নেয়া হয় বৈকালীর আদ্-দ্বীন আকিজ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর তার জন্য সিটি স্ক্যান করার প্রয়োজন হওয়ায় নেয়া হয় সোনাডাঙ্গার খুলনা হেলথ্ কেয়ার হাসপাতালে। সেখানে তার মৃত্যু হলেও খুমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। বিকেল সাড়ে চারটায় খুমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্মরত চিকিৎসক তাকে মৃত্যু সনদপত্র প্রদান করেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি’র অনুপ্রেরণায় গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক, খুলনার সদস্য এড. শামীমা সুলতানা শীলু বলেন, ওজোপাডিকো একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। তাদের অর্থনৈতিক কোন সংকট নেই। ভবনের সামনের দেয়ালও অনেকটা মজবুত করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু অপর তিন পাশের জরাজীর্ণ দেয়াল কেন ভেঙ্গে নতুন না করে কেন সংস্কার করা হলো সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এটি অনেকটা দুর্নীতির পর্যায় পড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর দায়ভার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেন না। যাদের কারণে একটি শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হলো তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। একইসাথে তিনি নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, যদিও মৃত্যুটি অপূরণীয় ক্ষতি। এ ক্ষতি কোন অর্থ দিয়ে পূরণ করা যায় না। তার পরেও যেহেতু শিশুটির পিতা একজন চা বিক্রেতা এবং তার পরিবার অনেকটা অস্বচ্ছল, তাই তাদের প্রতি নজর দেয়া উচিত।
ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপক(প্রশাসন) নাজমুল হক বলেন, এ ঘটনায় কোম্পানীর সদর দপ্তর থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। ওজোপাডিকোর প্রধান প্রকৌশলী(এনার্জি, সিস্টেম কন্ট্রোল এন্ড সার্ভিসেস) মো: মোস্তাফিজুর রহমানকে আহবায়ক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী(বাণিজ্যিক) রোকনুজ্জামানকে সদস্য সচিব করে গঠিত ওই কমিটির সদস্যরা হলেন, উপ-মহাব্যবস্থাপক(অডিট) মো: আজিজুর রহমান, সহকারী পরিচালক(নিরাপত্তা) মো: মোমিনুর রহমান এবং সহকারী পরিচালক(পূর্ত) রবিউল ইসলাম।
সংশ্লিষ্ট কাজের ঠিকাদার আব্দুল মান্নান বলেন, তিনি টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজটি পেয়ে বিগত ২/৩দিন আগে কাজটি শুরু করেন। যেখান থেকে দেয়ালটি ভেঙ্গে পড়েছে সেটি হেলে ছিল। হেলে পড়া অংশটি ভেঙ্গে ফেলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু তার আগেই দেয়ালটি হেলে পড়ে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। দীর্ঘ এ দেয়ালটিতে কোন আরসিসি পিলার না থাকার পরও কেন নতুন না করে এটি সংস্কার হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেভাবে ইঞ্জিনিয়াররা প্রাক্কলন করেন সেভাবেই তিনি কাজ করবেন এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু ইঞ্জিনিয়াররা কেন এভাবে প্রাক্কলন করলেন সেটি তার জানা নেই।
ওজোপাডিকোর বিবিবি-৪এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মামুনুর রহমান বলেন, এটি নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটি কি প্রতিবেদন দেয় তার ওপর নির্ভর করতে হবে। এখানে প্রাক্কলন কিভাবে করা হয়, কেন না ভেঙ্গে সংস্কার করা হয় সে ব্যাপারে তিনি তদন্ত কমিটির কাছে বলবেন অন্য কারো কাছে দায়বদ্ধ নন।
ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোঃ আজহারুল ইসলাম বলেন, ঘটনার সময় তিনি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তবে সার্বক্ষনিক তদারকি করে এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্তের পর তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান।