গত বছর থেকে ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নের সময় পার করছে গোটা বিশ্বের মানুষ। এমন বিধ্বংসী বছর আগে কখনো আসেনি। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ নামের যে প্রাণী সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে সমাজ সৃষ্টি করে, ২০২০ মানুষের সেই সভ্যতাকেই নাড়া দিয়েছে করোনা ভাইরাস। সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে পুরো পৃথিবীটাকেই স্তব্ধ করে দিয়েছে। মানুষখেকো করোনা ভাইরাস পরিচয় করিয়ে দিয়েছে-লকডাউন, আইসোলেশনের মতো চরম বাস্তব কয়েকটি শব্দের সঙ্গে। স্থবির হয়ে পড়ে সবকিছু। সবকিছুর মত বাদ যায়নি ক্রীড়াঙ্গন। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন থেমে ছিল দীর্ঘদিন। আনন্দের খবর বাংলাদেশের ক্রিকেট দল আবারো আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনলো। সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে জয়ী হয়ে প্রতিপক্ষকে হেয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। তাইতো উল্লাস বাঁধনহারা। এ জয় সত্যিই ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের জন্য গৌরবের আর আনন্দের। ক্রিকেটে শত প্রতিকূলতা কাটিয়ে নতুন দিগন্ত এনে দিয়েছে এই জয়। অভিনন্দন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। অনেক প্রশ্ন, সম্ভাবনা, শঙ্কা এবং আশার দোলাচল নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। প্রায় দশ মাসের বেশি সময় পর ক্রিকেটে ফেরা, যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অনেকটা নতুন শুরুর মতোই। দীর্ঘ এই বিরতির মাঝে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরে এসেছেন সাকিব আল হাসানও। সিরিজ শুরুর আগে সবচেয়ে বেশি চোখ ছিল তার ওপরই। এর বাইরে আলোচনায় ছিল আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগের পয়েন্ট টেবিলও। সরাসরি বিশ্বকাপ খেলতে হলে থাকতে হবে এই তালিকায় সেরা সাতে। সবমিলিয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়েই এ সিরিজ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। বলাবাহুল্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করার মাধ্যমে সেই মিশন সম্পন্ন হয়েছে। আছে অনেক প্রাপ্তি। অপেক্ষাকৃত খর্ব শক্তির দল হলেও সিরিজের আগে থেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। স্কোয়াডে বেশ কিছু নতুন মুখ থাকায় সেই দল সম্পর্কে খুব ধারণাও বাংলাদেশের ছিল না। তাই প্রতিপক্ষ নিয়ে না ভেবে নিজেদের শক্তিতেই আস্থা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ এবং সেই শক্তির ওপর ভর করেই মূলত সিরিজ জিতেছে তামিমবাহিনী। গোটা সিরিজের কোন পর্যায়েই প্রতিপক্ষকে নিজেদের ওপর চেপে বসতে দেয়নি বাংলাদেশ। আর সিরিজ জয়ের নায়ক হয়েছেন সাকিব আল হাসান। সাকিবের রোলার কোস্টার ক্যারিয়ারের আরেকটি নতুন বাঁক ছিল এই সিরিজ। এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর এটিই ছিল তার প্রথম আন্তর্জাতিক সিরিজ। এর আগে বঙ্গবন্ধু টি-২০ সিরিজে খেলেছিলেন তিনি। বল হাতে নৈপুণ্য দেখালেও ব্যাট হাতে সাকিব ছিলেন নিষ্প্রভ। অথচ বিশ্বকাপের মঞ্চে এই সাকিবের ব্যাটেই রানের ফোয়ারা ছুটেছে। বল হাতে ঘরোয়া টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স সাকিব ধরে রেখেছেন। সবমিলিয়ে নিজের সেরা ছন্দে না থেকেও সিরিজ সেরা হয়েছেন তিনিই। তাই পুরোপুরি পুরোনো সাকিব না ফিরলেও, ফেরার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। সামনের সিরিজগুলোতে বিশ্বকাপের সেই বিধ্বংসী সাকিবকে দেখার আশা করাই যায়। সাকিবের মত তামিমসহ অন্য টাইগাররাও আলো ছড়িয়েছেন, সম্ভাবনা জাগিয়েছেন। উল্লেখ্য, এই চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে টেস্ট হারের লজ্জায় ডুবেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের সেই দুঃস্বপ্ন বাংলাদেশ পেছনে ফেললো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ডুবিয়ে। সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে ১২০ রানের বড় জয়ে উইন্ডিজকে দ্বিতীয়বার ধবলধোলাইয়ের লজ্জায় ডোবালো বাংলাদেশ। যেকোনো দলের বিপক্ষে এই মাঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়ও এটি। ২০০৯ সালে প্রথমবার ক্যারিবিয়ানদের হোয়াইওয়াশ করে টাইগাররা। ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০০৬ সালে কেনিয়াকে গুঁড়িয়ে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের আনন্দে মাতে বাংলাদেশ। গত দেড় দশকে ১৪ বার প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করলো টাইগাররা। বাংলাদেশ এ সাফল্য ধরে রাখতে পারলে প্রত্যাশিতভাবেই সরাসরি ২০২৩ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। ভারতে অনুষ্ঠিতব্য এ আসরে সরাসরি ৮টি দল অংশ নেবে। বাকি দলগুলিকে বাছাইয়ের মাধ্যমে সে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। সে কারণে টাইগাররা সরাসরি বিশ্বকাপে খেলতে পারলে সেটি হবে দেশের জন্য বড় গৌরবের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে এবারের অর্জন ধরে রাখতে পারলে সে পথ অতিক্রম হয়তো অসম্ভব হবে না। সব মিলিয়ে উইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয় নিয়ে, বাংলাদেশ বন্দনা এখন সর্বত্র। বাংলাদেশ জয়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে খেলতে পারে। এই জয়ের আত্মবিশ্বাস ভালোর ছাপ রাখলে সেটি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে দেবে আরও। তবে এই সাফল্যের উচ্ছ্বাসে ঘরোয়া ক্রিকেটের দুর্বলতাগুলো ভুলে গেলেও চলবে না নিশ্চয়ই! সেই সঙ্গে আরো বেশী বেশী করে খেলার আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। এসব দিকে দৃষ্টি দিলে বাংলাদেশ ক্রিকেট আরো পরিণত হয়ে উঠতে পারবে-এমন আশা করা অমূলক হবে না। আর এমন দিনের অপেক্ষায় এদেশের লক্ষ-কোটি ক্রিকেটপ্রেমী। বাংলাদেশ ক্রিকেটের শত ফুল ফুটুক, শত সাফল্য ধরা দিক, শত সম্ভাবনা বিকশিত হোক। এমন প্রত্যাশা সবার।