পায়রা কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল ক্লাবে প্রবেশ করেছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এ ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে এশিয়াতে ৭ম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম এসেছে। এশিয়ার বাইরে ইউরোপ এবং আমেরিকাতেও খুব বেশি সংখ্যায় এ ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্র নেই। আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুত উৎপাদন প্রযুক্তিতে কম কয়লা ব্যবহার করে বেশি বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়াও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদানের নির্গমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আন্তর্জাতিক সব মাপকাঠিতেই এই প্রযুক্তিকে এখন পর্যন্ত কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য সর্বোত্তম বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল) পায়রাতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের সব থেকে বড় এই কেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উৎপাদনে এসেছে। কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। দেশের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট এ্যান্ড ইমপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) যৌথভাবে বিসিপিসিএল গঠন করেছে। বাংলাদেশ এবং চীন সরকার বিদ্যুত কেন্দ্রটির সমান অংশীদার। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র বলছে, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশের বড় এই অর্জন উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অনন্য এই অর্জনের খবর দেশবাসীকে জানাতে। এখন বিদ্যুত বিভাগের তরফ থেকে দেশবাসীর সামনে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য পাওয়ার সেলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়াতে ভারতে একটি এ ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া এশিয়ার মালয়েশিয়া, চীন, তাইওয়ান এবং জাপানে রয়েছে এ ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্র। তবে চীন ছাড়া কেউই ঢাকনাযুক্ত কোল ইয়ার্ড ব্যবহার করে না। পায়রাতে কয়লা রাখার জন্য ঢাকনাযুক্ত কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, কয়লা আনার সময় জাহাজে ঢেকে আনা হবে। এছাড়া কয়লা খালাস করার সময় যে কনভেয়ার বেল্ট ব্যবহার করা হবে তার পুরোটার উপরে ঢাকনা রয়েছে। ফলে কয়লা থেকে কোন উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা এখন তথ্য সংগ্রহ করছি। যে কোন সুবিধাজনক সময়ে আমরা দেশবাসীর সামনে আমাদের এই অর্জনের খবর তুলে ধরব। আমরা মনে করছি, কয়লা নিয়ে যে প্রচার রয়েছে তা’ স্তিমিত হবে। আমরা পরিবেশের ক্ষতি করে কিছু করছি না এটি মানুষ বুঝতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে বিনিয়োগ বেশি প্রয়োজন হলেও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যুত বিভাগ সে অনুযায়ী কাজ করছে। ফলে বাংলাদেশে বিদ্যুত খাতে যেসব কাজ হচ্ছে তা’ সবশেষ প্রযুক্তির। পাওয়ার সেল সূত্র জানায়, সারা পৃথিবীতে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুত কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৭৬ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। এরমধ্যে চীন এককভাবে উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে। চীনজুড়ে এ ধরনের ৩০টি কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫১ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট। এশিয়াতে চীন এবং ভারত বাদে আরও ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। যার বেশির ভাগই জাপানে। এছাড়া আমেরিকাতে ৬০৯ মেগাওয়াট, ইউরোপে তিন হাজার ৩৩২ মেগাওয়াট, আফ্রিকাতে এক হাজার ৩৮৬ মেগাওয়াট এ ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। তবে ভারতে এ ধরনের বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে ৬০৯ মেগাওয়াট। এনডব্লিউপিজিসিএল এবং বিসিপিসিএল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) প্রকৌশলী এ. এম. খোরশেদুল আলম বলেন, কম কয়লা পুড়িয়ে বেশি বিদ্যুত উৎপাদন করা যায়। এজন্য এ ধরনের প্রযুক্তিতে পরিবেশ দূষণ কম হয়। এছাড়া এ ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্রে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা ধরনের প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। ফলে পরিবেশের ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান ছড়িয়ে পড়তে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের কোল ইয়ার্ডটি ঢাকনাযুক্ত। জাপানেও এ ধরনের কোল ইয়ার্ড নেই। কেবল এশিয়াতে চীনই এ ধরনের কোল ইয়ার্ড ব্যবহার করে। আমাদের বিদ্যুত কেন্দ্রটির সালফার ডাইঅক্সাইড নির্গমণের হার মাত্র ৭০ থেকে ৮০ মিলিগ্রাম। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের বেঁধে দেয়া মাত্রা ২০০ মিলিগ্রাম। দেশে পায়রা ছাড়াও মাতারবাড়িতে আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এই কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রাষ্ট্রীয় কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি। কেন্দ্রটির ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে জাপানী একটি কোম্পানি। সুপার ক্রিটিক্যালের চেয়ে দুই ভাগ উৎপাদন দক্ষতা বাড়লেও ব্যয় অনেকটা বৃদ্ধি পায়। সঙ্গত কারণে অনেক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে আগ্রহী হয় না। এদিকে সফলভাবে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কম্পানি লিমিটেড প্রথম ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরা এই প্রকল্পের সার্বিক সফলতা কামনা করি।