/ কয়রার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে দক্ষিণ বেদকাশী

কয়রার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে দক্ষিণ বেদকাশী

এম এ হাওলাদার: রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যখন হঠাৎ গর্জে উঠেছিল জোয়ারের পানি, তখন কেউ টেরই পায়নি- জীবনের আরেকটি বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। খুলনার দাকোপের বটবুনিয়ায় বাঁধ ভাঙার সেই রাতে গ্রামের মানুষ দৌঁড়ে বেড়িয়েছে টর্চ হাতে। কারও ঘর তলিয়ে গেছে, কারও ধানগাছ ভেসে গেছে জোয়ারের পানিতে। তিনদিন পর পানি যখন নামলো, রয়ে গেলো শুধু নোনাজল আর চোখের পানি। এভাবেই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল আজ আর কেবল দুর্যোগের গল্প নয়, এটি বেঁচে থাকার, লড়াইয়ের আর আশার গল্প।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের এই দাকোপ, কয়রা আর শ্যামনগর, শরণখোলা- প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ের জীবন্ত প্রতীক। “ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায়”- এ যেন এখানকার মানুষের জীবনমন্ত্র। এক কথায় গোটা উপকূল যেন টিকে থাকার যুদ্ধক্ষেত্র।
১৯৭০ সালের ভয়াবহ ভোলা ঘূর্ণিঝড়, ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালের বন্যা, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা, ২০২০ সালের আম্পান- প্রতিটি দুর্যোগ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের বুক চিরে দিয়ে গেছে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুধুমাত্র আইলা ও আম্পানের পরিণতিতে খুলনা-সাতক্ষীরা উপকূলের প্রায় ৫০ হাজার পরিবার বাস্তচ্যুত হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আজও ঘরে ফিরতে পারেননি। ২৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমি চিরতরে নোনাজলে ডুবে গেছে, যা আর কোনোদিনই ধান ফলাতে পারবে না এমন আশংকা স্থানীয়দের। তাইতো জন্মস্থান থেকে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন খুলনায়। যাদের অনেকেই আজ শহরের বোঝা। নেই কর্মসংস্থান, ঘিঞ্জির পরিবেশে বাস করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন নানান রোগে।

গত ৭ অক্টোবর মধ্যরাতে দাকোপের বটবুনিয়ার বাঁধ ভেঙে আবারও সেই পুরনো দুঃসহ দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। জোয়ারের পানিতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ডুবে যায় বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। দাকোপ উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ শফিকুল ইসলামের দেওয়া তথ্য মতে, বাঁধ ভাঙায় ৩০২ হেক্টর জমির ধান ও শাকসবজি নষ্ট হয়েছে। ১৭০ জন কৃষক সরাসরি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ১০ লক্ষাধিক টাকা। যদিও তিন দিনের মাথায় বাঁধটি অস্থায়ীভাবে মেরামত করা হয়েছে, তবে স্থানীয়দের মতে, এটি টেকসই সমাধান নয়।

বটবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা দিলিপ কুমার সানা বলেন, বাঁধ ভেঙে বাড়ি-ঘর, ঘের, কৃষিজমি সব তলিয়ে গেছে।

ইউপি সদস্য সঞ্জয় সরদার বলেন, পাউবো’র দুর্বল কার্যক্রমের ফলে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। ভাটার সময় কাজ করার কথা থাকলেও জোয়ারের সময় কাজ করায় বাঁধ সংস্কারে দেরি হয়। প্রকল্প হয়, বিল বাড়ে কিন্তু জনভোগান্তি কমে না।

কয়রার কাটকাটা লঞ্চঘাটে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেলো, কপোতাক্ষ নদ এখন এমনভাবে দিক পরিবর্তন করছে যে কয়রার অংশ দিনদিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।

কাশীর হাটখোলা খেয়াঘাট থেকে শুরু করে সাতক্ষীরার গাবুরা পর্যন্ত নদীর ওপার জুড়ে নতুন চর গড়ে উঠেছে। সেই চরের চাপ ও প্রবাহের পরিবর্তনে কয়রার উত্তর বেদকাশীর কিছু অংশ ও দক্ষিণ বেদকাশীর সম্পূর্ণ অংশ ক্রমশ ভাঙনের কবলে। দক্ষিণ বেদকাশী যাওয়ার পথে গাববুনিয়া এলাকার স্থলভাগ দু’পাশের নদী থেকে এতোই সংকুচিত হয়ে আসছে যে, যে কোন সময় স্থলভাগ হারিয়ে পুরো এলাকা পরিণত হতে পারে একটি দ্বীপে। যার চারদিক হবে নদীবেষ্টিত। যার দুই পাশে ভয়ংকর সুন্দরবন, আর মাঝখানে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোঃ ওসমান গনি খোকন বলেন, এমনটি হলে দক্ষিণ বেদকাশীর ২৮ হাজার আর উত্তর বেদকাশির একাংশের মানুষের এই জনপদ হারাবে কৃষিজমি, ঘের ও স্থল যোগাযোগ। “তখন স্কুলে যেতে হবে নৌকায়, হাসপাতালে যেতে হবে নদী পেরিয়ে,”।
তাঁর মতে দক্ষিণ বেদকাশির সবচেয়ে বড় সংকট যোগাযোগ। সরকারিভাবে এলজিইডির রাস্তার কাজ বন্ধ কয়েক মাস। জেজেএসসহ কয়েকটি এনজিও ওই এলাকার উন্নয়নে চেষ্টা করছে। কিন্তু চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। ওই এলাকার অবস্থা এমন যে, “ওপারে বাঘ, নদীতে কুমির; ভেতরে ক্ষুধা আর বেকারত্ব।”

বেদকাশীর বাসিন্দা মোছাঃ রফিউন নেসা বলেন, “আমরা নদীর সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছি। কিন্তু এখন নদীই ঘরে ঢুকে পড়ছে। ঘর ঠিক করতে করতে জীবন পার হয়ে যাচ্ছে।”

যদি এই এলাকা সত্যিই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে হারিয়ে যাবে স্থল যোগাযোগ। বাজার, স্কুল, হাসপাতাল- সব হবে দূরের স্বপ্ন। নদীর ওপারেই বাঘ-কুমিরের রাজ্য; এপারে মানুষের ভাঙা জীবন।

শনিবার কয়রা ও পাইকগাছার পৃথক দুটি সমাবেশ থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনোনীত এমপি প্রার্থী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ যখন তার ২০ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন, তার মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল- টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ।
স্থানীয়রা বলছেন, রাজনীতি বদলায়, মুখ বদলায়- কিন্তু বাঁধের দুরবস্থা বদলায় না। প্রতি মৌসুমেই বাঁধ ভাঙে, নতুন করে তহবিল আসে, কাজ শুরু হয়, আবার কিছুদিন পর সেই বাঁধও ভেঙে যায়।

পরিবেশবিদরা বলছেন, বাঁধ শুধু মাটি দিয়ে নয়, বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনায় নদীর গতিবিধি, স্রোতের দিক ও ভূমির স্তর বিবেচনা করে তৈরি করা দরকার। নচেৎ “যেভাবে চলছে, সেভাবেই আবার ভাঙবে।”

তবু মানুষ থেমে নেই। ঘূর্ণিঝড় আসে, ঘর ভাঙে, আবার ঘর ওঠে। বীজ বোনা হয়, শিশুরা স্কুলে যায়, নারীরা ঘরে ঘরে চিংড়ি চাষে সাহায্য করে।
পরিদর্শনকালে কথা হয় বেসরকারি সংস্থা জাগ্রত যুব সংঘ-জেজেএস’র একটি প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প কর্মকর্তা নাজমুল হুদার সাথে। তিনি বলেন, উপকূলের এসব মানুষের প্রতিদিনই যুদ্ধ করতে হয়। সে যুদ্ধ পেটের জন্য, ক্ষুধার যন্ত্রণা নিবারনের জন্য। যেটি কোন একক সংস্থার পক্ষে দূর করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস।