করোনায় গত এক মাসে যারা মারা গেছেন, তাদের ৮০ ভাগই ভ্যাকসিন নেননি। বাকি ২০ ভাগ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি নানা ধরনের দীর্ঘস্থায়ী জটিল রোগে ভুগছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এমন তথ্য জানিয়েছে। ঢাকায় এখন যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের ৬৯ শতাংশই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনে সংক্রমিত বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সেটা আগে ১৩ শতাংশে ছিল। এদিকে, করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তারের মধ্যে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আর শনাক্তের হারে বাংলাদেশ ফিরে গেল পাঁচ মাস আগের পর্যায়ে। গতকাল সোমবার (১৭ জানুয়ারি) এক দিনেই রোগী বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার, যা আগের দিনের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। করোনার শনাক্তের হারও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, এখন প্রতিদিন করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকবে। আগামী ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ থাকতে পারে। এখন সবাইকে সচেতন হতে হবে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে লকডাউন না দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। শুধু মাস্ক পরেই ৯০ ভাগ নিরাপদ থাকা যায়।

ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে সরকারের ১১ দফা নির্দেশনা কেবল কাগজে-কলমেই। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে যেমন নেই সচেতনতা, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন তেমন ভূমিকা রাখছে না। সর্বত্রই স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা উপেক্ষিত। অথচ করোনা সংক্রমণের হার ইতিমধ্যে ২০ ভাগ ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ উচ্চ ঝুঁকির পর্যায়ে আছে দেশ। হাসপাতালে ১০ শতাংশ হারে রোগী ভর্তি বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘করোনায় আক্রান্তের হার বেড়ে যাওয়া অশুভ ইঙ্গিত। আমরা যদি নিজেদের সংবরণ না করি, এটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা শক্তিশালী না করি তবে পরে বিপদের বড় আশঙ্কা আছে।’ গতকাল সোমবার বিকালে এক ভাচু‌র্য়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আরো বলেন, করোনা শনাক্তের হার দুই সপ্তাহ আগেও ২ শতাংশের নিচে ছিল। গতকাল ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। দুই সপ্তাহের মধ্যে অনেকখানি বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘অনেকে ভাবছে ওমিক্রনে ভয়ের কারণ নেই। কারণ এখানে মৃত্যুর হার কম। আমাদের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং আইইডিসিআর জিনোম সিকোয়েন্স করছে। তারা বলছেন, ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের হার বেশি। ওমিক্রন বাড়ছে, তবে সেটা ডেলটার মতো না। ঢাকায় ওমিক্রনের হার বেশি। তবে সামগ্রিকভাবে ডেলটার প্রাধান্য সব জায়গায় বেশি। অন্যান্য শহরে ওমিক্রন নেই। ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের পরিণতি আপনারা আগেই দেখেছেন।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নইলে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে। ভোগান্তি বাড়বে। কোনো পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে দ্রুত পরিবারটির সবাই সংক্রমিত হবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, এখন প্রতিদিন করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। যেহেতু কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানে না, তাই ভবিষ্যতে কী হবে তা বলা যাবে না। তবে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা চলতে থাকলে আগামী ফেব্র‚য়ারি-মার্চ মাসে দেশে করোনা পরিস্থিতি উচ্চ ঝুঁকিতে থাকতে পারে। তিনি বলেন, কোথাও স্বাস্থ্যবিধি নেই। রাজধানী থেকে শহর কিংবা গ্রামের মানুষ মাস্ক পরে না, স্বাস্থ্যবিধি মানে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির চাকা সচল রাখার স্বার্থে সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, করোনায় মৃত্যু বাড়ার কারণ টিকা না নেওয়া। দেশে টিকা নেওয়ার সহজ পদ্ধতি করেছে সরকার। জন্মনিবন্ধন কিংবা ইউপি চেয়ারম্যানের লিখিত কপি নিতে গেলেই টিকা দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে হাতের কাছেই ইপিআই কেন্দ্রে টিকা প্রদান করা হচ্ছে। তবে মনিটরিং না করায় অনেক ওয়ার্ডে টিকা দেওয়ার জন্য টাকা চাওয়া হচ্ছে। মতলবের কয়েকটি স্থানে টিকার জন্য টাকা চাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে সঠিকভাবে মনিটরিং করা উচিত। আর টিকা গ্রহণের মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত এক দিনে ৩১ হাজার ৯৮০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৬ হাজার ৬৭৬ জনের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। রবিবার ২৯ হাজার ৩০৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫ হাজার ২২২ রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এক দিনে এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল সর্বশেষ গত বছরের ১৮ আগস্ট, সেদিন ৭ হাজার ২৪৮ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। সোমবার নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশে, গত বছরের যা ১৩ আগস্টের পর সর্বোচ্চ। সেদিন শনাক্তের হার ছিল ২৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৭ জনে। গত এক দিনে ১০ জনের মৃত্যু হওয়ায় মহামারিতে বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৮ হাজার ১৫৪ জনে দাঁড়াল। সরকারি হিসাবে গত এক দিনে দেশে করোনা থেকে সেরে উঠেছেন ৪২৭ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫৩ হাজার ৩২০ জন সুস্থ হয়ে উঠলেন। করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে বাংলাদেশে এক সপ্তাহে কোভিড রোগী বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার। সেই সঙ্গে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যা।