জনবল সংকটের মধ্যেই চালু
করতে হচ্ছে ডেঙ্গু ইফনিট

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ করোনার পর ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়ায় খুলনার মধ্যে বড় চাপটিই বহন করতে হচ্ছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে। কেননা ইতোমধ্যে জেনারেল হাসপাতালের আন্ত: ও বহি:বিভাগের রোগীদের সেবা বন্ধ করে দিয়ে যেমন শুধুমাত্র করোনা ইউনিট পরিচালিত হচ্ছে তেমনি শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালেও পৃথক করোনা ওয়ার্ড করার পাশাপাশি সেখানে নির্দিষ্ট কিছু বিভাগের রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। আর আন্ত: ও বহি:বিভাগের রোগীদের সেবা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি খুমেক হাসপাতালের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে ২শ’ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল এবং নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা সেবা। সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি পৃথক দু’টি ইউনিট পরিচালনার জন্যও মূল ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে মেডিসিন বিভাগের ওপর। অথচ ৫শ’ বেডের এ হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে চলছে বিপুল পরিমান জনবল সংকট। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এ হাসপাতালে পরিচালক থেকে শুরু করে সেবাতত্ত্বাবধায়ক পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ২৮৬টি পদের মধ্যে ১৫৩টি পদই শূণ্য রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকট রয়েছে মেডিকেল অফিসার ও সহকারী রেজিষ্ট্রার। মেডিকেল অফিসারের ৫১টি এবং সহকারী রেজিষ্ট্রারের ৫৮টি পদ শূণ্য রয়েছে বলে হাসপাতালের পরিচালক ডা: মো: রবিউল হাসান জানান।
এদিকে, চরম জনবল সংকটের মধ্যেই খুমেক হাসপাতালে চালু করতে হচ্ছে নতুন একটি ওয়ার্ড। এজন্য গতকালকের প্রস্তুতি সভা থেকে মেডিসিন ওয়ার্ডের ওপর ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালুর দায়িত্ব দেয়া হয়। হাসপাতালের চতুর্থ তলার দু’টি কক্ষে পুরুষ ও মহিলা রোগীদের জন্য ১০টি করে আপাতত: ২০টি বেডের ওই ওয়ার্ডটি চালু হতে যাচ্ছে বলেও গতকালকের সভায় সিদ্ধান্ত হয়। আগামীকাল শনিবার থেকে না পারলেও ২/১দিনের মধ্যেই সেখানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি শুরু হবে বলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মনে করছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই এই সাত মাসের আন্ত: ও বহি:বিভাগের রোগী সেবার তথ্যচিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, খুমেক হাসপাতালে প্রতিদিন যেমন গড়ে এক হাজারেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকছেন তেমনি বহি:বিভাগেও প্রতি মাসে ২০ হাজারের ওপরে রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। করোনা ও চলমান লকডাউন পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে সাধারণ রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও শয্যা অনুযায়ী দ্বিগুন রোগী থাকছে। কিন্তু প্রতি মাসেই জনবলের অভাব বলে হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পত্র দেয়া হলেও সেটি একই অবস্থায় পড়ে থাকছে। আর জনবল না বাড়লেও নিত্য নতুন ইউনিট বাড়িয়ে একই জনবল দিয়ে পরিচালনা করতে হচ্ছে হাসপাতালটি। যেটি অনেকটা সংকট সৃষ্টি করছে বলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মনে করছেন।
হাসপাতালের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেয়া গত মাসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রেজিষ্ট্রারের ৪২টি পদের মধ্যে ১৭টি, মেডিকেল অফিসারের ৮৮টির মধ্যে ৫১টি, সহকারী রেজিষ্ট্রারের ৯১ পদের মধ্যে ৫৮টি এবং ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারের ছয়টি পদের মধ্যে চারটিই শূণ্য রয়েছে।
তবে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা পদমর্যাদার উপ-সেবাতত্ত্বাবধায়ক থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পর্যন্ত পদগুলো মোটামূটি পূরণ থাকলেও সেখানেও ছয়টি পদ শূণ্য রয়েছে। এর মধ্যে সিনিয়র স্টাফ নার্সের তিনটি পদ যেমন শূণ্য রয়েছে তেমনি উপ-সেবাতত্ত্বাবধায়ক পদটিও শূণ্য রয়েছে। এতে নার্সিং সুপারভাইজারদের মধ্য থেকে একজন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও এ নিয়ে নার্সদের মধ্যে চাপা সংকট দেখা দিয়েছে।
মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট থেকে শুরু করে ক্যাশসরকার পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদও শূণ্য রয়েছে ২১টি। অর্থাৎ ৫২টি পদের মধ্যে ৩৫টিতে লোকবল থাকলেও বাকী ২১টি রয়েছে শূণ্য। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণিরও ১০৭টি পদের মধ্যে রয়েছেন ৭২জন। অর্থাৎ সেখানেও ১৭টি পদ শূণ্য রয়েছে। যদিও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সংকট মোকাবেলা করা হচ্ছে আউটসোর্সিং কর্মচারীদের দিয়ে। কিন্তু সেখানেও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কথায় কথায় চাকরী চলে যাওয়ায় সেখানেও চাকরীর নিশ্চয়তায় না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন এসব কর্মচারীরা। যেটি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আর একটি অন্তরায় উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দিয়ে স্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হলে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে মধ্যসত্ত্বভোগীরাও সরকারি ও গরীব মানুষের অর্থ লুফে নিতে পারবেন না।
ডেঙ্গু ওয়ার্ডের প্রস্তুতি ঃ জনবল সংকট থাকলেও ডেঙ্গু ওয়ার্ডের জন্য পৃথক জায়গা নির্ধারণ করা হচ্ছে। গতকালকের বৈঠকে এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের পরিচালক ডা: মো: রবিউল হাসানের সভাপতিত্বে গতকাল দুপুরে অনুষ্ঠিত কনফারেন্স রুমের বৈঠকে হাসপাতাল ও কলেজের বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক-শিক্ষকরা অংশগ্রহণ করেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, খুমেক’র অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা: মো: আব্দুল আহাদ, উপাধ্যক্ষ ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজ, শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক খান গোলাম মোস্তফা, ডা: খসরুল আলম মল্লিক, ডা: মামুন উর রশীদ, ডা: এসএম তুষার আলম, হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা: অপর্ণা বিশ^াস, ডা: উৎপল, ডা: মোয়াজ্জেম হোসেন, ডা: শৈলেন্দ্রনাথ বিশ^াস, ডা: প্রিতীষ তরফদার, আরএমও ডা: সুহাস রঞ্জন হালদার ও ডা: অঞ্জন চক্রবর্তী, কনসালটেন্ট ডা: আনন্দ দ্যুতি হিরা, মেডিকে অফিসার ডা: জিল্লুর রহমানসহ সকাল ইউনিটের রেজিষ্ট্রার ও সহকারী রেজিষ্ট্রারবৃন্দ ।
বৈঠকে ডেঙ্গু ওয়ার্ড পরিচালনার জন্য মেডিসিন বিভাগের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই বিভাগের চিকিৎসকা বসে রোষ্টার ঠিক করা, মুখপাত্র নির্ধারণসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করেই পরিচালকের কাছ থেকে অনুমোদন নেবেন বলেও বৈঠকের একটি সূত্র জানায়।
আরও ২ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ঃ খুমেক হাসপাতালের প্যাথলজী বিভাগে কর্মরত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনষ্টিটিউটের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট ও প্যাথলজী বিভাগের অন্যান্য সহযোগিরা জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার চারটি নমুনা পরীক্ষার পর দু’জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে একজন হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন এবং অন্যজন নিজ উদ্যোগে পরীক্ষা করিয়ে শনাক্ত হওয়ার পরও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বিভাগে একজনের শনাক্ত ঃ খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক দপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা: ফেরদৌসী আক্তার বলেন, গতকাল সকাল পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘন্টায় খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে শুধুমাত্র নড়াইলের লোহাগড়ায় আরও একজনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে বিভাগে মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৬ জনে।
বিশেষজ্ঞ মতামত ঃ বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা: এস,এম কামাল বলেন, দু’ থেকে তিনদিন জ¦র থাকার পর সেরে গিয়ে আবারেও ২/১দিনের মধ্যে জ¦র হলেই ডেঙ্গু সন্দেহের রোগী বলে ধরে নেয়া হয়। এজন্য তিনটি পরীক্ষার পর রিপোর্ট পজিটিভ হলেই ডেঙ্গু শনাক্ত রোগী হিসেবেই বিবেচিত হয়।
ডেঙ্গু থেকে রক্ষার জন্য তিনি ডেঙ্গু মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বিশেষ করে একই স্থানে ২/৩ সপ্তাহ পানি জমতে না দেয়া, বাড়ির আশেপাশে গর্ত, টায়ার, নারকেলের খোসা ইত্যাদি মশার প্রজনন যাতে না হতে পারে সেটি নিশ্চিত করার পাশাপাশি মশা মারার ওপরও জোর দেন।
সংকট যেখানে প্রকট ঃ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু রোগীর মূলত: রক্তের প্লেটেলেট কমে যায়। সাধারণনত প্লেটেলেট দেড় লাখের নিচে নেমে গেলেই পজেটিভ রোগী ধরা হয়। এছাড়া আইজিজি, আইজিএম পরীক্ষার পরও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়। রক্তের প্লেটেলেট কমে গেলে রক্ত থেকে শুধুমাত্র প্লেটেলেট আলাদা করে রোগীকে দেয়া হয়। কিন্তু খুলনায় সরকারি কোন হাসপাতালে প্লেটেলেট আলাদা করার মেশিন নেই। একমাত্র বেসরকারি আকিজ আদ দ্বীন হাসপাতালে এ মেশিনটি রয়েছে। যেটি অনেকটা ব্যয়বহুল। কিন্তু খুমেক হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হলেও সেল সেপারেট বা এ্যাফারেসিস মেশিনের এখনও কোন ব্যবস্থা না করায় রোগী সেবায় বিঘœ ঘটতে পারে বলেও সংশ্লিষ্টরা আশংকা করছেন।