‘আপনার প্রয়োজনে ঔষধ নিন
অন্যের প্রয়োজনে ঔষধ দিন’

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ কয়রার উত্তর বা দক্ষিণ বেদকাশি, দাকোপের নলিয়ান বা কামারখোলা অথবা সাতক্ষীরার শেষ সীমানা কালিগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা রোগীর স্বজনদের যখন বাইরে থেকে ওষুধ কেনার অর্থ থাকে না, খাবার না পেয়ে যখন অভুক্ত থাকতে হয় অথবা রোগীর চাপের কারণে যখন হাসপাতালের সামনে এ্যাম্বুলেন্সে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা অক্সিজেন সংকটে রোগীদেরকে ভুগতে দেখা যায় তখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এগিয়ে আসলো খুলনা অক্সিজেন ব্যাংক।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আওতাধীন পরিচালিত ১৫০ শয্যা বিশিষ্ট করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের গেটেই গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে ব্যতিক্রমী এ সেবা। ‘আপনার প্রয়োজনে ঔষধ নিন, অন্যের প্রয়োজনে ঔষধ দিন’ এ শ্লোগান নিয়ে খুলনা অক্সিজেন ব্যাংকের ফ্রি মেডিসিন সেবা ও ফ্রি খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রথম দিনেই ১৬ জন ভর্তি রোগীকে ওষুধ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে বলে জানালেন খুলনা অক্সিজেন ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবকরা।
খুলনা অক্সিজেন ব্যাংকের মূল উদ্যোক্তা সালেহ উদ্দিন সবুজ। গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে তাকে পাওয়া না গেলেও কথা হয় স্বেচ্ছাসেবক মেহেদী হাসান সুমন ও কোষাধ্যক্ষ আসাদ শেখের সাথে। তারা বললেন, অনেক সময় দেখা যায়, দূর থেকে আসা রোগীরা হাসপাতালে ভর্তির প্রক্রিয়া করতে গিয়ে বিলম্বের ফলে বাইরেই ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় থাকেন। এসময় ভাড়ায় চালিত এ্যাম্বুলেন্স থেকে অক্সিজেন সরবরাহ অনেকটা ব্যয়বহুল হয়। যা অনেক গরীব রোগীর পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। এজন্যই তাৎক্ষনিক ওই রোগীকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিতেই তাদের এ উদ্যোগ। এছাড়া অনেক রোগীকে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। বিশেষ করে রেমডিসিভির গ্রুপের এক একটি ইনজেকশনের খুচরা মূল্য পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। একজন করোনা পজেটিভ রোগীর জন্য প্রয়োজন ছয়দিনে ছয়টি। যা অনেকের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। অনেক সময় অবশ্য কোম্পানীর কাছ থেকে সরাসরি কেনার পরামর্শও দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু সেখান থেকেও তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার নিচে কেনা সম্ভব নয়। যদিও ওই একই ইনজেকশন বাইরের অনেক ফার্মেসীতে আড়াই হাজার টাকারও কমে কেনা সম্ভব। তার পরেও একজন রোগীর জন্য ফুল কোর্স ইনজেকশনের জন্য খরচ হয় ১৫ হাজার টাকার উপরে। যা অনেক গরীব রোগীদের পক্ষে কেনা সম্ভব হয় না। এজন্য হাসপাতালের মূল গেটের পাশেই তারা ফ্রি মেডিসিন সেবা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
ফ্রি অক্সিজেন সেবার মাধ্যমে আগে থেকেই তারা শহরের বিভিন্ন স্থানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে আসছেন উল্লেখ করে মেহেদী হাসান সুমন বলেন, গত বছর করোনার শুরুতেই তারা অক্সিজেন ব্যাংকের যাত্রা শুরু করেন। তাদের এ সেবামূলক কাজে এগিয়ে আসেন দেশ-বিদেশের অনেকে। তাদের রয়েছে ৪০ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবক টিম। হটলাইনে অক্সিজেন সংকটের কথা শোনা মাত্রই তারা ছুটে যান সেখানে। দিনে-রাতে যে কোন সময় তারা দিয়ে থাকেন এ সহায়তা। মাত্র পাঁচটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে যাত্রা করলেও আজ তাদের সিলিন্ডারের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। খুমেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটেও তাদের পক্ষ থেকে মাঝারী সাইজের ২৫টি সিলিন্ডার দেয়া হয়েছে। অনেক সময় রিফিল করতে গিয়ে দেরি হওয়ায় রোগীদের অক্সিজেন সংকটে পড়তে হয়। এজন্য তারা সেখানে ওই সিলিন্ডারগুলো দিয়ে রেখেছেন যাতে সেগুলো রিফিল করে রাখার ফলে রোগীরা সেবা পান। তাদের ওই ক্যাম্পে ওষুধের পাশাপাশি রাখা হয়েছে বেশকিছু সিলিন্ডারও। যা দিয়ে দূর দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের প্রাথমিক সাপোর্ট দেয়া হবে।
অক্সিজেন ও ওষুধের পাশাপাশি তাদের রয়েছে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থাও। সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ আসাদ শেখ বলেন, প্রতিদিন দুপুরে একশ’ করে খাবার প্যাকেট এনে রোগীর স্বজনদের মধ্যে বিলি করা হবে। কেননা হাসপাতাল থেকে শুধু রোগীকে খাবার দেয়া হলেও তার সাথে থাকা ভিজিটরকে বাইরের খাবার কিনে খেতে হয়। যা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এজন্য এমন লোকদের জন্য তাদের ফ্রি খাবার বিতরণ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। প্রথম দিনে গতকাল একশ’ প্যাকেট খাবার রোগীর স্বজনদের মধ্যে বিলি করা হয় বলে কোষাধ্যক্ষ জানান।
তিনি আরও বলেন, এর বাইরেও খুলনা অক্সিজেন ব্যাংক শুরুর আগেই খুলনা ফুড ব্যাংকের কার্যক্রম চালু ছিল। যেটি করোনাকালীন সময়ও অব্যাহত রয়েছে। ফুড ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর শহরে ঘুরে ঘুরে যেসব অসহায়, দু:স্থ ও পথচারী রয়েছে তাদের খুঁজে বের করে খাবার বিতরণ করা হয়। করোনা হাসপাতালের ফ্রি খাবার বিতরণ কর্মসূচি থেকে যেসব খাবার অতিরিক্ত থাকবে সেগুলো সন্ধ্যার পরের ওই কর্মসূচির সাথে অন্তর্ভুক্ত করে অভুক্তদের মাঝে বিলি করা হবে বলেও তিনি জানান।
এর বাইরেও বিগত এক মাস আগে থেকে করোনা হাসপাতালে ডিউটিরত আউটসোর্সিং কর্মচারীদের মাঝে রাতে খাবার বিতরণ কর্মসূচি চালু রয়েছে উল্লেখ করে অক্সিজেন ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, অনেক সময় কম বেতনে কর্মরত আউটসোর্সিং কর্মচারীরা রাত আটটায় ডিউটিতে এসে সারারাত করোনা হাসপাতালে অবস্থান করেন। তাদের জন্য রাতের খাবার ব্যবস্থা করেন তারা।
অবশ্য এ সেবাকে অনেকে স্বাগত জানালেও এটিও অনেকটা করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি বলেও অবিহিত করেছেন। কেননা অক্সিজেন ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবকরা যেমন করোনা ওয়ার্ডে অবস্থান করেন এবং তাদের সিলিন্ডার সরকারি হাসপাতালে সরবরাহের ফলে অনেক সময় সেগুলো বদল হওয়ারও আশংকা থাকে। এজন্য অহরহ করোনা হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকদের যাতায়াতের ওপরও বিধি-নিষেধ আরোপের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখার আহবান জানিয়েছেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে করোনা হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত খুমেক হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার(আরএমও) ডা: অঞ্জন কুমার চক্রবর্তী বলেন, আগে যেহেতু হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন ছিল ১০ হাজার লিটারের একটি এখন সেখানে দু’টি হয়েছে। সুতরাং এখন থেকে সিলিন্ডারের তেমন প্রয়োজন নাও হতে পারে। তবে রোগীর সংখ্যা বাড়লে এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সহায়তার প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সবকিছু করা হবে বলেও তিনি জানান।