এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ কানায় কানায় পূর্ণ খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল। বেড না থাকায় মেঝেতে রাখতে হচ্ছে রোগী। আবার স্বাস্থ্যকর্মীদের ডেকে না পেয়ে রোগীর ভিজিটরদের নিজেদেরকেই করতে হচ্ছে অক্সিজেন লেবেল ঠিক করার কাজটি। এতে কোন কোন রোগীর অক্সিজেনের মাত্রাও ঠিক থাকছে না।
শুক্রবার মধ্যরাতে রেডজোনে ডিউটিরত একজন নার্স এ পতিবেদককে বললেন, রোগীর স্বজনরা অক্সিজেনের লেবেল ঘুরিয়ে দেয়ায় অনেক সময় অক্সিজেন অপচয় হচ্ছে। এর ফলে বাজেট অনুযায়ী অক্সিজেনের সংকট হচ্ছে কখনও কখনও। যেটি অন্য রোগীদের জন্য অনেক সময় ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এদিকে, এ হাসপাতালে ঘন্টায় ঘন্টায় মারা যাচ্ছেন করোনা রোগী। শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা থেকে গতকাল শনিবার বিকেল সোয়া তিনটা পর্যন্ত বিগত ১২ ঘন্টায় এ হাসপাতালে সর্বমোট আটজনের মৃত্যু হয়। আবার খুলনা জেনারেল হাসপাতালে গতকাল সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টা অর্থাৎ আধা ঘন্টার মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ মারা না গেলেও আগের দিন দু’জনের মৃত্যু হয়। এভাবে খুলনার করোনা হাসপাতালগুলো যেন ক্রমান্বয়ে লাশের ভারে ভারী হয়ে উঠছে। একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় কান্নাও যেন থামছে না।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আওতাধীন পরিচালিত করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় মৃত্যুবরণ করেন নগরীর ৯৬ নম্বর শেরে বাংলা রোডের বাসিন্দা ইব্রান আলী স্বপন(৪০)। করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ১৪ জুন।
এর ঠিক ৪৫ মিনিট পর অর্থাৎ গতকাল ভোররাত সোয়া চারটার দিকে মৃত্যুবরণ করেন শেখ শহিদুল্লাহ(৭৪) নামের বাগেরহাট সদরের হাড়িখালি এলাকার এক বাসিন্দা। তাকে ভর্তি করা হয় ২৩ জুন।
তার ঠিক ৮৫ মিনিট পর অর্থাৎ ভোর পাঁচটা ৪০ মিনিটের দিকে মৃত্যু হয় বাগেরহাট সদরের আরও এক বাসিন্দা মিঠুন পাল(২৮) নামের একজনের। তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ২৪ জুন।
আবার ওই মৃত্যুর ৩০ মিনিটের মাথায় অর্থাৎ ছয়টা ১০ মিনিটে মৃত্যু হয় একই এলাকার অর্থাৎ বাগেরহাট সদরের কুলসুম বেগম(৯০) নামের এক রোগীর। তাকে আগের রাতেই এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এর দু’ঘন্টা পর অর্থাৎ গতকাল সকাল আটটা ১০ মিনিটে খুলনার আড়ংঘাটা থানার গাইকুড় এলাকার লামিম ওরফে লেলিন(৬২) নামের এক রোগীর মৃত্যু হয়। তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল ২০ জুন।
আবার তার মাত্র আড়াই ঘন্টার মাথায় সকাল সাড়ে ১০টায় মৃত্যু হয় খুলনা সদর থানাধীন রূপসা স্ট্যান্ড রোডের ডাক্তার বাড়ি গলির বাসিন্দা নুরজাহান বেগম(৩৮) নামের একজনের। তাকে শুক্রবার এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
তার দু’ঘন্টার মাথায় অর্থাৎ দুপুর সাড়ে ১২টায় মৃত্যু হয় যশোর সদরের পালবাড়ি এলাকার বাসিন্দা ফাতেমা পারভিন(৩৩) নামে রোগীর। তাকে গতকালই ভর্তি করা হয় এ হাসপাতালে।
সর্বশেষ গতকাল বিকেল সোয়া তিনটার দিকে মৃত্যু হয় বাগেরহাটের মংলার জালাল উদ্দীন জামাল(৫০) নামে এক রোগীর। তাকে গত ১৮ জুন এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
খুমেক’র করোনা হাসপাতালের মুখপাত্র ডা: সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, প্রতিদিনই বেডের অতিরিক্ত রোগী থাকছে এ হাসপাতালে। গতকাল সকালেও এ হাসপাতালে রোগী ছিল ১৫৬জন। অথচ হাসপাতালটি একশ’ বেড থেকে বাড়িয়ে সম্প্রতি ১৩০ বেড করা হয়। আবার বিকল্প হিসেবে খুলনা জেনারেল হাসপাতালেও ৭০ বেডের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল চালু করা হয় এক সপ্তাহ আগে। কিন্তু রোগীর চাপ কমছে না কোন হাসপাতালেই।
জেনারেল হাসপাতালেও প্রতিদিন প্রায় ৭০জনের মতো রোগী থাকছে বলে ওই হাসপাতালের মুখপাত্র ডা: কাজী আবু রাশেদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গতকাল সকালেও মাত্র আধা ঘন্টার ব্যবধানে দু’জনের মৃত্যু হয়। এদের একজন সাতক্ষীরার এবং একজন যশোরের।
খুলনার একমাত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একশ’ বেডের করোনা ইউনিট রয়েছে। সেখানেও প্রতিদিন প্রায় একশ’র কাছাকাছি রোগী থাকছে। গতকাল সকালে ওই হাসপাতালে ৯০জন রোগী অবস্থান করছিলেন বলে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা: গাজী মিজানুর রহমান জানান। গতকাল সেখানে কোন মৃত্যু না হলেও আগের দিন অর্থাৎ শুক্রবার দু’জনের মৃত্যু হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরা হলেন, যশোরের কেশবপুরের জিয়াউর রহমান(৪২) ও মনিরামপুরের মো: ইসহাক সানা(৮০)।
খুলনার সরকারি-বেসরকারি এ তিনটি হাসপাতাল এলাকা মাঝে মধ্যে স্বজনদের আহজারীতে প্রতিদিনই ভারী হয়ে উঠছে। তখন অন্যদেরকে নিরব দর্শক ছাড়া শান্তনা দেয়ার কোন ভাষা থাকে না। আবার কখনও পাশের বেডের রোগীর মৃত্যু হলেও নিজ রোগীকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় অন্য রোগীর স্বজনদের। বেডের অপেক্ষায় থাকা কোন কোন রোগীর স্বজনদের অন্যের মৃত্যুও কামনা করতে হয়। মানবিকতার বালাই না থাকলেও এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলছেন, এটিই এখন বাস্তবতা। অনেক সময় চিকিৎকদেরকেও বলতে হয়, ‘একটু অপেক্ষা করুন, একটা রোগীর মৃত্যু হতে পারে, হলে বেড পাবেন’। বিশেষ করে আইসিইউ’র ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায়।