* পাওনা পরিশোধে প্রয়োজন সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা
* অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তৈরি হয়েছে দালাল শ্রেণি
* ব্যানবেইস কার্যালয়ে ধর্ণা দিয়েও মিলছে না অর্থ
* অবসরের পর কেটে যায় বছরের পর বছর
* আর্থিক সংকটের কবলে ব্যানবেইস

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ ঝালকাঠির একটি মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত নারী শিক্ষক অসুস্থ অবস্থায় হাজির হয়েছিলেন ঢাকার পলাশী-নিলক্ষেতের বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বা ব্যানবেইস কার্যালয়ে। টাঙ্গাইলের একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকও বয়সের ভারে নুব্জ হয়ে পড়েন। লাঠি ভর দিয়ে আসেন কেউ কেউ। ঢাকার আশপাশের এলাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সেখানে গিয়ে চেষ্টা করছেন কারও সাথে যোগাযোগের। সারাজীবন স্কুল-কলেজ বা মাদ্রাসায় চাকরীর পর অবসর ও কল্যাণ ট্রাষ্টের টাকাটা পাওয়া যায় কি না সে আশায়ই তাদের এমন অসহায়ত্ব। আর তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কিছু তথাকথিত দালাল শ্রেণির লোকেরও সমাগম চোখে পড়ে।
যদিও সেখানের নোটিশ বোর্ডে দেয়া রয়েছে সতর্কবার্তা। শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব অধ্যক্ষ মো: শাহজাহান আলম সাজু সতর্ককরণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতারক হতে সাবধান হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ রয়েছে অতিরিক্ত কল্যাণ ট্রাস্টের সুবিধা পাইয়ে দেয়ার নাম করে কেউ কেউ ব্যানবেইস কর্মকর্তা সেজে অনেকের কাছে ফোন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রতারক হতে সাবধান থাকার আহবান জানানো হয় ওই নোটিশে।
এর পরেও একজন অসুস্থ নারীকে দেখিয়ে ওই অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বললেন, ওই যে দেখেন, বিগত ২০ বছর আগে তার স্বামী অবসরে গেছেন। পরে তিনি মারাও যান। কিন্তু এখনও তার টাকাটা পাননি। এখন এসেছেন এখানকার কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য। কিন্তু কারও মাধ্যম ছাড়া তিনি যেতে পারছেন না। তিন বছর আগে অবসরে গিয়েও অবসর সুবিধা পাচ্ছেন না এমন অনেকেই রয়েছেন। তবে মুসলমানদের মধ্যে যারা হজ্বে যাবেন তারা এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যারা তীর্থস্থান ভ্রমণে যাবেন এমন অবসরি শিক্ষক-কর্মচারীদের দেয়া হচ্ছে কল্যাণ ট্রাষ্টের টাকা।
এভাবেই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে যারা অবসরে গেছেন তাদেরকে বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে টাকার আশায়। সম্প্রতি ঢাকার ওই ব্যানবেইস কার্যালয়ে গিয়ে দেখা মেলে অবসরগ্রহনকারী অনেক শিক্ষক-কর্মচারীর এমন অনেক করুণ চিত্র। অর্থ খরচ করে গুটি কয়েক লোক সেখানে যাওয়ার সুযোগ পেলেও অনেকেই অনলাইনে আবেদন করেই অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। ব্যাংকের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছেন আর মোবাইলের এসএমএস’র দিকে তাকিয়ে থাকছেন। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও অবসর সুবিধা বা কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পাচ্ছেন না বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। যদিও ব্যানবেইস কর্তৃপক্ষ বলছেন, অর্থ সংকটের কারণে দেয়া যাচ্ছে না অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাষ্টের টাকা।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের উপপরিচালক মো: আবুল বাশার বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। যা নিষ্পত্তি করতে প্রায় দু’ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে এক পর্যন্ত দেড় লাখ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীকে চার হাজার ৮২ কোটি টাকা কল্যাণ সুবিধা বাবদ প্রদান করা হয়েছে। কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে শতকরা চার ভাগ হারে মাসিক চাঁদা আদায় হয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে এ বাবদ আয়ের পরিমাণ ৫৪০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রতিমাসে কল্যাণ সুবিধা দেয়া হয় প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে প্রায় ১০ কোটি টাকা এবং বার্ষিক ঘাটতির পরিমাণ ১২০ কোটি টাকা।
অপরদিকে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সহকারী প্রোগ্রামার মো: জামাল হোসেন বলেন, সেখানে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আবেদন জমা রয়েছে ৩৮ হাজার টাকা। যা নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। অবসর বোর্ডের পক্ষ থেকেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রতি মাসে গড়ে নয়শ’টি আবেদন জমা পড়ে। অর্থাৎ বছরে যার সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮শ’টি। যা নিষ্পত্তি করতে মাসে ১১০ কোটি করে বছরে এক হাজার ৩২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এমপিও’র ৬% থেকে মাচে ৬৭ কোটি হারে বছরে ৮০৪ কোটি টাকা এবং এফডিআরের লভ্যাংশ থেকে বছরে ৩৬ কোটি টাকা আয় হলেও প্রতি মাসে অবসর সুবিধা বোর্ডে ঘাটতি থাকে ৪০ কোটি টাকা। বছরে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৮০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মোট সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হলেও ব্যানবেইসের কাছে স্থায়ী আমানত যা রয়েছে তা দিয়ে কোনদিনই অবসরগ্রহণকারীদের পাওনা পরিশোধ সম্ভব নয়।
অবশ্য বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এ বিশাল ঘাটতি মেটাতে সম্প্রতি সরকার স্থায়ী আমানত না বাড়িয়ে ওই টাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১শ’ টাকা করে আদায় করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়। এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রতি বছর ভর্তির সময়ে এই টাকা নেয়া হবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। এছাড়া এসএসসি এইচএসসি, ডিগ্রি এবং মাস্টার্স ফরম পূরণকালেও পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে একই হারে টাকা আদায় করা হবে। এর মধ্যে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তি ও ফরম পূরণের টাকা শিক্ষা বোর্ডগুলো সংগ্রহ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের নির্দিষ্ট হিসাবে পাঠাবে। আর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের টাকা সরাসরি কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে মহাপরিচালকের হিসাবে জমা হবে। পরে ওই টাকা অবসর বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টের নির্দিষ্ট হিসাবে জমা পড়বে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ২১৭ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ হবে। এই অর্থ দিয়ে উভয় সংস্থা বর্তমানের তুলনায় গড়ে ৪ হাজার জনের আর্থিক দাবি অতিরিক্ত পূরণ করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
যদিও সরকারের এমন সিদ্ধান্তের সাথে ঘোর বিরোধিতা করছেন শিক্ষক নেতারা। বিশেষ করে অবসর সুবিধা আইন ও শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট আইনটি ২০০২ সালে যাদের চেষ্টায় পাশ হয়েছিল সেই সময়ে প্রথম সারিতে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ মাজহারুল হান্নান বলেন, এটি অত্যন্ত খারাপ একটি সিদ্ধান্ত। শিক্ষার্থীরা বেতন দিয়ে পড়ছে আবার শিক্ষকদের অবসরকালীন সুবিধার টাকা তাদের কাছ থেকে নিতে হবে কেন ? সরকারের পক্ষ থেকে কেন কয়েক হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ এ খাতে দেয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্নও তোলেন তিনি।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় অতিরিক্ত মহাসচিব ও খুলনা জেলা সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার সাহা বলেন, পেনশনের বিকল্প হিসেবে অবসর সুবিধা আইন ও শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট আইনটি করা হলেও এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ না দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে কেন টাকা আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে সেটি বুঝে আসছে না। এ ক্ষেত্রে তিনি ব্যানবেইসের আয়ের পথ সৃষ্টির পরামর্শ দিয়ে বলেন, প্রয়োজনে ব্যাংক তৈরি করা যেতে পারে। যাতে আর্থিক সংকট দূর হয়।
অবসরগ্রহণকারী শিক্ষক কর্মচারীদের দুরাবস্থার কথা তুলে ধরে এই শিক্ষক নেতা বলেন, একজন শিক্ষক বা কর্মচারী যখন অবসর গ্রহণ করেন তখন তাদের অনেক আশা থাকে, অনেক পরিকল্পনা থাকে। অবসরের ৫/৬মাসের মধ্যেই যদি ওই টাকাটা পাওয়া যায় তখন তারা সেটি কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু বছরের পর বছর টাকার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে অনেকেই অকালে মৃত্যুবরণ করেন। মানসিক চাপের মধ্যে থেকে ইতোমধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন এমনটিও উল্লেখ করেন তিনি।
অপরদিকে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য অবসর বোর্ডের অনুকূলে দু’হাজার ২শ’ কোটি টাকা ইতোমধ্যে বরাদ্দ দিয়েছেন। আমার মেয়াদককালে অর্থাৎ আগামী দু’বছরের মধ্যেই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরের অর্থ প্রাপ্তির যন্ত্রণাকর অবস্থার অবসান হবে বলেও তিনি মনে করেন। এছাড়া বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরাও পেনশন সুবিধার আওতায় আসবেন বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।