ব্যতিক্রমী চাকরি মেলায় শতাধিক প্রতিবন্ধীর আবেদন
এ এইচ হিমালয় ঃ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ডান হাত কেটে ফেলতে হয়েছে বেলাল হোসেনের। এক হাত দিয়েই ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকেই চাকরি খুঁজছেন তিনি। কিন্তু একটি হাত না থাকায় সবাই ফিরিয়ে দিচ্ছিলো। পরিচিত একজনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের চাকরির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে শুনে খুলনার আভা সেন্টারে যান তিনি।
সোমবার দুপুরে বেলাল হোসেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো, তখন জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে সেখানে উপস্থিত প্রায় শতাধিক তরুণ-তরুণী। তাদের কারও চোখ নেই, কারও হাত নেই। অনেকেই স্বাভাবিকভাবে হাটা চলা করতে পারেন না। তবে সবারই চোখেমুখেই ছিলো নিজের চেষ্টায় কিছু করার অদম্য আত্মবিশ্বাস।
শারীরিক নানা ত্রুটি নিয়ে অবহেলায় থাকা এসব তরুণ-তরুণীদের জন্য ব্যতিক্রমী চাকরি মেলার আয়োজন করা হয় সেখানে। আর চাকরির সুযোগ দিতে সেখানে উপস্থিত ছিলো খুলনা শিপইয়ার্ড, সালাম গ্রুপ, লকপুর গ্রুপসহ খুলনার খ্যাতনামা ২৪টি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশান অন ডিসেবিলিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এডিডি) ইন্টারন্যাশনাল ছিলো এই মেলার আয়োজক।
বিভিন্ন সময় খুলনায় চাকরি মেলা হয়েছে। কিন্তু শুধু প্রতিবন্ধীদের জন্য চাকরি মেলা এবং খ্যাতনামা কোম্পানির উপস্থিতি খুলনায় এটাই প্রথম।
বেলাল হোসেন জানান, একটি হাত না থাকায় তার চলার পথে কোনো বাঁধা হতে পারেনি। কারও বোঝা হতে চান না তিনি। নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি চান। এজন্য বিভিন্ন কোম্পানিতে আবেদন করেছেন।
মেলায় আসা নগরীর আযমখান কমার্স কলেজের ডিগ্রী তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আজমীর হোসেন জানান, জন্ম থেকেই একটি পা নেই তার। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট আজমীরের ইচ্ছা কারও বোঝা হয়ে না থেকে নিজের চেষ্টায় কিছু করার। তিনি বলেন, খুলনার বড় বড় কোম্পানিগুলো প্রতিবন্ধীদের চাকরির ব্যবস্থা করছে শুনে এখানে এসেছি। ৬টি কোম্পানিতে জীবন বৃত্তান্ত দিয়েছি।
একবছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গেছেন শারমীন আকতারের। তিন বছরের এক সন্তান নিয়ে ভাইয়ের বাসায় আছেন। পায়ে ত্রুটি থাকায় হাটতে কিছুটা সমস্যা হয়। মেলায় জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে আসা শারমীন বলেন, একটি চাকরির খুব প্রয়োজন। কিন্তু পা নিয়ে সব জায়গায় যেতে পারি না। ৭টি প্রতিষ্ঠানে জীবন বৃত্তান্ত জমা দিয়েছি। এখন অপেক্ষায় আছি। কারও দয়া বা বোঝা নয়। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি করে সন্তানকে নিয়ে বাচতে চাই।
সালাম গ্রুপের প্রধান মানব সম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক এম এম রাজিকুল ইসলাম জানান, আমাদের ক্যাসেল সালাম হোটেলে ৩ জন, জুট মিলে ৫ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী কাজ করছেন। অন্যদের তুলনায় তারা ভালো কাজ করে। এজন্য মেলায় এসেছি। জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে যাচ্ছি, যাচাই-বাছাই করে পরে আমরা তাদের ডাকবো।
খুলনার সিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মানব সম্পদ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপক হামিদুল ইসলাম খান বলেন, হাসপাতাল ছাড়াও আমাদের দুটি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় লোক লাগবে। আমরা শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী লোক নেব।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এস হুমায়ুন কবীর বলেন, খুলনার বিভিন্ন মাছ কোম্পানিতে প্রতিবন্ধীরা কাজ করেন। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তারা কাজে ফাঁকি দেন কম। পান, বিড়ি-সিগারেট খেতে বাইরে যান না। অন্যদের তুলনায় কাজে বেশি মনোযোগী। যার কারণে ১০টি মাছ কোম্পানি মেলায় এসেছে। সবাই তাদের কারখানায় লোক নেবে।
আয়োজক সংস্থা অ্যাকশান অন ডিসেবিলিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এডিডি) ইন্টারন্যাশনালের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী এম ডি আসাদুল্লাহ বলেন, আমরা দুই বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণ, কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করছি। তারই ধারাবাহিকতায় এই মেলার আয়োজন। কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা প্রতিবন্ধীদের কাজের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে খুবই আন্তরিক। আশা করছি অনেকেই মেলার পরে চাকরি পাবেন।
॥ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ॥
দুপুর সাড়ে ১২টায় বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করেন খুলনার জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার মেলার উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এস হুমায়ুন কবীর। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক প্রকৌশলীব শেখ মফিজুর রহমান, খুলনা চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মফিদুল ইসলাম টুটুল এবং উইমেন চেম্বারের বিভাগীয় শামিমা সুলতানা শিলু।
উপস্থিত ছিলেন এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. শফিকুল ইসলাম, বিবিডিএন-এর হেড অফ অপারেশন আজিজা আহমেদ, প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার আব্দুর রাকিব প্রমুখ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ৭ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে হুইল চেয়ার, এ্যালব ক্রাচ, ক্রাচ, হেয়ারিং এইড বিতরণ করা হয়।