ক্লাস শুরুর দাবিতে অভিভাবকদের স্মারকলিপি পেশ, কাল মানববন্ধন
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) অচলাবস্থার ঠিক পাঁচমাস পূর্ণ হয়ে গতকাল(১৮ জুলাই)। এই পাঁচ মাসে মেঘ কিছুটা কাটতে শুরু করলেও সিদ্ধান্তহীনতা ও প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতায় চূড়ান্ত সমাধান এখনো সুদূর পরাহত। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে শিক্ষকদের একাংশের ব্যক্তিগত উদ্যোগ আশার সঞ্চার করলেও শিক্ষক সমিতির অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব এবং উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্থবিরতায় সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সর্বশেষ বুধবার একজন শিক্ষক নিজ ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে ক্লাসে ফেরার ঘোষণা দিয়েও যাননি। শোনা যাচ্ছে আরও অনেক শিক্ষক তার এ আহবানে সাড়া দিয়েছেন। এজন্য শিক্ষক সমিতির সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করেই তারা আগামীকাল রবিবার থেকে ক্লাসে যাবেন।
এদিকে, কুয়েটের ক্লাস দ্রæত চালু করার জন্য গার্ডিয়ান ফোরাম ঢাকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’র চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আগামীকাল রবিবার বেলা ১১টায় কুয়েটের প্রশাসনিক ভবনের সামনে মানব বন্ধন আহবান করা হয়েছে। ক্লাস শুরুর দাবিতে তারা এ মানব বন্ধন করবেন বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া আগামীকাল ২১-২২ ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন।
দীর্ঘ অচলাবস্থার পর সম্প্রতি পুরকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্লাস চালুর ঘোষণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া ফেলে। তাঁর এই উদ্যোগকে অনুসরণ করে আরও কয়েকটি বিভাগ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সাপেক্ষে একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। এই ইতিবাচক আবহাওয়ায় শিক্ষার্থীরাও ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের আবাসিক হলগুলোতে ফিরতে শুরু করেছে।
তবে এই আশাবাদের বিপরীতে শিক্ষক সমিতির নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব ভুগছে। যা তাদের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধকে স্পষ্ট করে তুলেছে। গত দু’দিন ধরে কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহিদুল ইসলামের মোবাইলে একাধিকবার রিং করা হলেও সেটি রিসিভ হয়নি।
অপর একটি সূত্র বলছে, সমিতির দায়িত্বশীল কয়েকজন সদস্য সম্প্রতি দুই দফায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও একজন প্রভাবশালী সদস্যের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ইউজিসি থেকে তাঁদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আগে ক্লাস-পরীক্ষা চালু করলেই কেবল উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হবে। ইউজিসি’র যুক্তি, গত ১৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১-তম সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুসারেই ৪ মে থেকে ক্লাস চালুর কথা ছিল। যা শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণেই বাস্তবায়ন হয়নি। তাই অচলাবস্থা ভাঙার দায়িত্ব এখন শিক্ষকদেরই নিতে হবে।
ইউজিসি’র এই অবস্থানের কারণে সমিতির ভেতরে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সভায়ও কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সভায় একাধিক সদস্য মত দেন যে, ক্লাস চালুর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সাধারণ সভা আহ্বান করা উচিত। ফলে, কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষে একক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। সভায় উপস্থিত একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমনটি জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র মনে করছে, কুয়েটের সংকটের মূলে রয়েছে উপাচার্য পদের দীর্ঘদিনের শূন্যতা। গত ১০ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় উপাচার্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলেও এবং কুয়েটের জন্য ২০ জন অধ্যাপক আবেদন করলেও অদৃশ্য কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি থমকে আছে। বরং উপাচার্য নিয়োগ না দিয়ে গত ১৫ জুলাই ইউজিসির একজন পরিচালকের ওপর আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এর মধ্যদিয়ে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়াটি যে পিছিয়ে যাচ্ছে সেটিও মনে করছেন অনেকে। এ সংক্রান্ত একটি সূত্র জানায়, ভিসি নিয়োগের আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে সাক্ষাৎকারের প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ। কিন্তু সার্চ কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব করছে।
উপাচার্য না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রশাসনিক ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও ঝুলে গেছে। ফলে কুয়েট কার্যত একটি স্থবির ক্যাম্পাসে পরিণত হয়েছে।
সূত্র মতে, কুয়েট সংকটের সূত্রপাত হয় গত ১৮ ফেব্রæয়ারির ঘটনায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত থেকে। শিক্ষার্থীদের অনশনের মুখে শিক্ষা উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে ২৩ এপ্রিল ১০২-তম সিন্ডিকেটে কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়াই সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। যা সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে অনেকে মনে করছে।
কুয়েটের একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ শিক্ষক দ্রæত ক্লাসে ফিরতে চান। কিন্তু যেই মুহূর্তে অধিকাংশ শিক্ষক ক্লাসে ফিরে যেতে চাচ্ছেন, ঠিক তখনই শিক্ষক সমিতির সভাপতি সমিতির হোয়াটসএ্যাপ গ্রæপের কমেন্ট সেকশন বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনটি উল্লেখ করে একজন শিক্ষক সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্টও দিয়েছেন।
এদিকে, শিক্ষক সমিতি সব ফ্রন্টে হেরে গিয়ে এখন নিজেদের পছন্দের একজনকে কুয়েটের পরবর্তী ভিসি বানানোর এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের চেষ্টা তদবির করে যাচ্ছে বলেও জনশ্রæতি রয়েছে। যার অংশ হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানান প্রপাগন্ডা ছড়ানো হচ্ছে।
সব মিলিয়ে একদিকে সংকট সমাধানের চেষ্টা যেমন চলছে অন্যদিকে সেটিকে বাঁধাগ্রস্থ করতেও চলছে নানা ষড়যন্ত্র। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
অপরদিকে, টানা পাঁচ মাস কুয়েটের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাদেরকে সে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে অভিভাবকদের পক্ষ থেকেও গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
গার্ডিয়ান ফোরাম ঢাকার পক্ষ থেকে দেওয়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশের অন্যতম স্বনামধন্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) আজ পাঁচ মাসের অধিক সময় ধরে অচল অবস্থার কারণে একাডেমিক কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। ফলে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থীর জীবন ভীষণ হুমকির সম্মুখীন। আমরা অভিভাবকরা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে জীবন যাপন করছি। এমনিতেই এদেশে প্রতি বছর ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী হতাশা, দুশ্চিন্তা, বেকারত্ব, পাসের পর অনিশ্চিত জীবন ও পারিবারিক চাপে আত্মহত্যা করে, করোনার সময় দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। সন্তানদের নিয়ে ঘরের মধ্যে দুর্বিষহ বন্দীজীবন কাটিয়েছি অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে এভাবে ছয় মাস সময় নষ্ট না হলে একজন শিক্ষার্থী ৬ মাস আগে জব মার্কেটে প্রবেশ করতে পারত।’ স্মারকলিপিতে দ্রæত কুয়েটের ক্লাস চালুর দাবি জানানো হয়।
অভিভাবক ফোরামের পক্ষে এ সময় উপস্থিত ছিলেন, বিকাশ কুমার শীল, মোঃ আনোয়ার হোসেন, হাসান জুলকারলীন, মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ বাহার উদ্দিন।