দিচ্ছি দেবো বলেই পার হলো এক সপ্তাহ
ট্যাংকি বসিয়েও রিফিল হচ্ছে না অক্সিজেন

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ ‘দিচ্ছি, দেবো, এইতো কালকের মধ্যেই দেয়া যাবে, আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে দিয়ে দেবো’ এভাবেই অতিবাহিত হয়েছে এক সপ্তাহ। অথচ শুধু ট্যাংকিটাই এখন সার। একদিকে প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্যই কেটে গেলো প্রায় চার মাস অপরদিকে এখন লিকুইড অক্সিজেন রিফিল করতেও হচ্ছে বিলম্ব। অথচ ট্যাংকি স্থাপন থেকে শুরু করে পাইপ লাইন সংযোজন দেয়া হয়েছে তড়িঘড়ি করে। একমাত্র ভ্যাকুম রুম ছাড়া বাকী কাজ সম্পন্ন হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। ভ্যাকুম রুম নির্মানে দেরি হবে বলে হাসপাতাল ভবনেরই একটি কক্ষ দেয়া হয়েছে ভ্যাকুম রুম হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু অক্সিজেন রিফিল করতেই করা হচ্ছে গড়িমসি। স্পেক্ট্রা কোম্পানীর খুলনা বিক্রয় কেন্দ্রের ইনচার্জ বললেন, ঢাকা থেকে সিদ্ধান্ত না হয়ে আসা পর্যন্ত তার কিছুই করার নেই। গতকাল দুপুরে তিনি বলেন, এ নিয়ে বিকেলে মিটিং আছে, তখন জানানো যাবে। বিকেলে ফোন দিলে বলেন, সন্ধ্যায় মন্ত্রণালয়ের সাথে জুম মিটিং আছে, তার পর জানা যাবে। আর রাত সাড়ে নয়টায় ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘অফিসে আসেন বলছি’। আবার রাত সাড়ে ১০টায় ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘মিটিং হয়েছে সিদ্ধান্ত জানি না’।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের জন্য স্থাপিত স্পেক্ট্রা কোম্পানীর লিকুইড অক্সিজেন রিফিল নিয়ে এভাবেই চলছে লুকোচুরি খেলা। এ খেলার শেষ কবে হবে সেটি জানেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। হাসপাতালের পরিচালক বললেন, চুক্তিসহ সকল কাগজপত্র সম্পন্ন। এখন শুধু লিকুইড অক্সিজেন রিফিল করলেই রোগীদের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব। কিন্তু দিচ্ছি- দেবো বলেই কাটিয়ে দেয়া হচ্ছে সময়।
এদিকে, সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটের কারণে বেসরকারি কিছু অক্সিজেন ব্যাংকের লোকজন অনায়াসেই ঢুকছে করোনা হাসপাতালে। এর ফলে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে আইসোলেশন নামের ওই ইউনিটটি। সেই সাথে সরকারি অক্সিজেন সিলিন্ডারও বহিরাগতদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে এমনটিও অভিযোগ রয়েছে। অক্সিজেন ব্যাংকের নামে সরকারি সিলিন্ডার নিয়ে সম্প্রতি ধরাও পড়েছে কয়েকজন। অর্থাৎ সবকিছুই যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
খুমেক হাসপাতালের করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সার্বিক সমন্বয়কারী, খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ও খুলনা বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজ গত ১৭ জুন তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে একটি পেষ্ট দিয়ে এই অক্সিজেন ট্যাংকটি বসানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, এখন থেকে আর এ হাসপাতালের অক্সিজেনের সংকট থাকবে না। দু’টি সেন্ট্রাল লাইন থেকে রোগীদের দেয়া হবে অক্সিজেন। বাকী যারা রয়েছেন তাদেরকে দেয়া হবে অক্সিজেনের মাধ্যমে। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কেননা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই বসুন্ধরা থেকে স্পেক্ট্রা কোম্পানীর ওই ট্যাংকি খুলনায় আনা হয়।
অবশ্য, খুলনা মেডিকেলে ট্যাংকি এনে কয়েক মাস ফেলে রাখা হয়েছিল। ট্যাংকটি স্থাপনের জন্য স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ৯৭ লাখ টাকার একটি প্রস্তাবনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠালে সেখান থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে আবারো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠিয়ে মতামত চাওয়ার পর মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নিজস্বভাবে ট্যাংকি বসানোর নির্দেশ দেয়। এরপর টেন্ডার আহবানের পর কার্যক্রম শুরু হয়। অর্থাৎ এভাবে পত্র চালাচালি আর মতামত নিতেই চলে যায় প্রায় চার মাস। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে ট্যাংকটি বসানো হলেও অক্সিজেনের লাইন সংযোগ দিয়ে ভ্যাকুম রুমের কাজ চলছে। কিন্তু যতদিন ভ্যাকুম রুম না হবে ততোদিন রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহের জন্য খুমেক হাসপাতালের আইসিইউ ভবনেরই একটি কক্ষে অর্থাৎ যেটি বর্তমানে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার একটি কক্ষ প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু সর্বশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে স্পেক্ট্রা কোম্পানীর অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষেত্রে।
কোম্পানীর স্থানীয় বিক্রয় প্রতিনিধি সজিব রায়হান বলেন, তিনি নিজেও চেষ্টা করছেন, কিন্তু ঢাকা থেকে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত তিনি কোন মন্তব্য করতে পারছেন না। ঢাকা অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পরে নাম্বার যোগাড় করা হয় স্পেক্ট্রা কোম্পানীর চীফ টেকনিক্যাল অফিসার সোহরাব উদ্দিনের। কিন্তু তাকেও একাধিকবার ফোন দিয়ে পাওয়া যায়নি। পরে তার নম্বরে এসএমএস ও হোয়াটসএ্যাপে লিখেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর(এইচইডি) খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশুতোষ কর্মকার বলেন, ট্যাংকি বসানোসহ ভিতরের পাইপ লাইনও টানা হয়েছে। এখন এইচইডির কোন কাজ নেই। এখন ট্যাংকির মধ্যে লিকুইড রিফিল করতে হবে। হাসপাতালের সাথে স্পেক্ট্রার চুক্তিও হয়েছে। এখন লিকুইড দিলেই রোগীদের মাঝে অক্সিজেন সরবাহ করা সম্ভব।
খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা: মো: রবিউল হাসান বলেন, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে চুক্তিও হয়েছে। স্পেক্ট্রা কোম্পানী কেন দিচ্ছে না তাও কিছু জানায়না। তারা বলে যে, এই সপ্তাহে দেবো, এই সপ্তাহে দেবো। এই বলেই সময় পার করা হচ্ছে।
হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা: দিলিপ কুমার কুন্ডু বলেন, বর্তমানে করোনা ইউনিটসহ পুরো হাসপাতালে লিন্ডে কোম্পানীর সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। যেসব রোগী অতিরিক্ত বেডে আছে তাদেরকে দেয়া হয় সিলিন্ডারের মাধ্যমে। লিন্ডে কোম্পানীর এক হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার ট্যাংকটি একদিন পর একদিন আবার কখনও প্রতিদিন রিফিল করা হয়। স্পেক্ট্রাও এক হাজার লিটারের ট্যাংক বসিয়েছে। দু’টি ট্যাংকি থেকে অক্সিজেন দেয়া হলে সিলিন্ডারের ওপর চাপ কমবে। এছাড়া হাসপাতালে যে ৩৫টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে সেগুলো দিয়েও রোগীদের কিছুটা সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। এর ফলে যেসব রোগীদের আইসিইউ প্রয়োজন তাদেরকে সাধারণ বেডে রেখেও হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করে সেবা দেয়া সম্ভব। তবে সম্প্রতি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে যে চারটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দেয়া হয়েছে তাতেও অক্সিজেন বেশি খরচ হওয়ায় সেগুলো কুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ টিমকে দেখানো হয়েছে। অক্সিজেন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব হলে সেগুলোও চালু করা হবে। এছাড়া যেসব রোগীদের জন্য অক্সিজেন কম প্রয়োজন তাদেরকে অক্সিজেন কনসিনটেটরের মাধ্যমেও কিছুটা সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান। এ ধরনের কনসিনটেটরের সংখ্যা আছে ৩৬টি। যেগুলো অক্সিজেন তৈরি করে। যা থাকলে সেন্ট্রাল অক্সিজেন বা সিলিন্ডারের প্রয়োজন হয়না। সেযব রোগীর মিনিটে পাঁচ থেকে সাত লিটার অক্সিজেন হলে হয় তাদেরকে ওই মেশিন দিয়েও সেবা হয়।
এখন যে অবস্থা তাতে স্পেক্ট্রা কোম্পানীর রিফিল শুরু হলেই আপাতত অক্সিজেনের কোন সংকট থাকবে না। কিন্তু স্পেক্ট্রা কোম্পানী প্রতিদিনই রিফিল করে দিচ্ছে। আজ বলে কাল দেবো, কাল বলে পরশু। এভাবেই চলছে রিফিল প্রক্রিয়া।
অপরদিকে, বর্তমানে এ হাসপাতালে প্রতিদিন ১.৩৬ সাইজের(ছোট) অক্সিজেন সিলিন্ডার দু’থেকে আড়াইশ’, ৬.৮ সাইজের(মাঝারী) সিলিন্ডার ২০ থেকে ২৫টি এবং ৯.৬৮ সাইজের(বড়) সিলিন্ডার প্রয়োজন বলে খুমেক হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার(আরএমও) ডা: অঞ্জন চক্রবর্তী জানিয়েছেন। লিন্ডের সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন থেকেও বড় ধরনের সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। তবে স্পেক্ট্রার অক্সিজেন সরবরাহ চালু হলে সংকট কেটে যাবে।