# জিআই পণ্য: টাঙ্গাইল শাড়ীর পর সুন্দরবনের মধু এখন ভারতের
ফারুক আহমেদ।। খুলনাঞ্চলের অন্তত ৩টি পণ্যকে জিআই পণ্য হিসেবে বিবেচনার জন্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার দাবি উঠেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনার বিখ্যাত ‘চুই ঝাল’, বটিয়াঘাটার ‘ভাইটাল চাল’, বা ‘রাণীসালুট চাল’, পারশে মাছ, সরপুরিয়া, হরিধান, কালামনা ধান ও সাদাজেবরা ধান ইত্যাদি। এছাড়াও খুলনাঞ্চলে বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিভিত্তিক যে উপাদনসমূহ আনাচে-কানাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গুরুত্ব বিবেচনায় সেগুলিকেও জিআই বা ভৌগলিক নিদর্শন পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্তির দাবি উঠেছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ীর পর এবার সুন্দরবনের মধুর জিআই সনদ বা ‘ভৌগলিক নিদর্শন’ স্বস্ত প্রাপ্তির পর এখন সুন্দরবনের মধু ভারতের বলে দাবি করেছে ভারত।
জানা যায়, বাংলাদেশে জিআই পণ্য বা ভৌগলিক নিদর্শন সম্পর্কিত পণ্য এখন আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি জেলাভিত্তিক দেশের জিআই হিসেবে নিবন্ধিত পণ্যগুলি যাতে দ্রুততার সাথে নিবন্ধিত করা হয় সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের ‘জিআই পণ্য’ হিসেবে ভারতের দাবির কথা পত্রিকায় প্রকাশ পেলে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারপরই তরিঘরি করে টাঙ্গাইল শাড়ীকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে জার্নালে প্রকাশ করা হয়। সুন্দরবনের মধু ভারত নিজেদের বলে দাবি করতে পারে এমনি একটি কথা কিছুদিন আগে জানা গেলেও ৩দিন আগে ভারত সুন্দরবনের মধু নিজেদের স্বত্বের কথা প্রকাশ করেছে। এমনি অবস্থায় চরম হতাশা এবং ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ, গবেষকসহ মধু আহরণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িতরা। তাদের মতে, সুন্দরবনের আয়তন ও মধু উৎপাদন সবই বাংলাদেশ অংশে বেশি থাকা সত্ত্বেও নিজেদের পণ্য হিসেবে মধুর আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক নির্দেশক সনদ বা জিআই সনদ পেলো না বাংলাদেশ। তাদের মতে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বহীনতার কারণে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। আর ভারত বাগিয়ে নিয়েছে মধুর জিআই সনদ। উল্লেখ্য, সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটাল। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশে রয়েছে ৬৫১৭ বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ মোট আয়তনের ৬৬ ভাগ। পক্ষান্তরে ভারতের মধ্যে পড়েছে ৩৪৮৩ বর্গ কিলোমিটার বা ৩৪ ভাগ। অনুতাপের বিষয় হলো সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা বাংলাদেশের হওয়া সত্বেও এই অঞ্চলের মধুর স্বীকৃতি নিল ভারত। প্রতি বছর বাংলাদেশ মোটামুটি ৩শ মেট্রিন টন মধু আহরণ করে। ভারত করে ১০৫ মেট্রিক টনের মত। সে বিবেচনায় বাংলাদেশ এ সনদ নিতে পারল না।
বন বিভাগের এক বিশেষজ্ঞের মতে, সুন্দরবনে সাধারণ উচু উদ্ভিদগুলিতে বেশী ফুল ফোটে। এ গাছগুলির মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, বাইন ও কেওড়া। সুন্দরবনে এ উদ্ভিদ রয়েছে প্রায় ৪৪- থেকে ৫০ শতাংশ। বেশী ফুলে যে গাছে সে গাছে বেশী মৌমাছি যাবে, সেখানে মধু বেশী হবে- এটাই স্বাভাবিক। আর বাকী অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অল্প উচ্চতার গড়ান অন্যতম। গড়ানে মধু হয়। পক্ষান্তরে সুন্দরবনের ভারতের অংশে তীব্র লবণাক্তার কারণে গড়ানের সংখ্যাই বেশী। প্রায় ৯০ শতাংশ। এ কারণে ভারতে প্রধানত গড়ান ফুলের মধুই পাওয়া যায় বেশী। এ মধুর স্বাদ ভিন্ন এবং বৈচিত্র্যও কম। বাংলাদেশে গড়ানসহ সুন্দরী, বাইন ও কেওড়া অন্যান্য প্রজাতির সংখ্যাধিখ্য থাকায় নানা স্বাদ, গন্ধ ও গুণগতমানের এবং বৈচিত্রময় মধু পাওয়া যায় যার পরিচিতি বিশ্বময়। অথচ সুন্দরবনের মধুর এ বিষয়টিতে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, প্রতিটি দেশের কিছু সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক নিদর্শন থাকে যেগুলি সে দেশের জাতিসত্ত্বা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, খাদ্যাভাস, লোকায়িত জ্ঞান, পরিবেশ-প্রতিবেশ, শিক্ষা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদির উপর নির্ভর করে তিলতিল করে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠিত দীর্ঘকালের এ বিষয়গুলি একটি সময় ঐ জাতির সম্পদে পরিণত হয় যেগুলি সে জাতির মেধাস্বত্ব বা ভৌগলিক নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে জামদানি শাড়ী-কে বাংলাদেশে প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর হতে পর্যায়ক্রমে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় আরো ২০টি পণ্য। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাতি আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুর কাটারীভোগ, বাংলাদেশ কালিজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, বাংলাদেশের শীতল পাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলশীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বাংলাদেশের ব্লাক বেঙ্গল ছাগল, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা। সম্প্রতি টাঙ্গাইল শাড়ি, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা ও গোপালগঞ্জের রসগোল্লার অনুমোদন দেয়া হয়। সম্প্রতি আরও ৪টি পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে যুক্ত হয়। এগুলি হলো-রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম, মৌলভীবাজরের আগর, মৌলভীবাজারের আগর আতর এবং মুক্তাগাছার মন্ডা। পণ্যগুলি আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, লোকায়িত জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। এগুলি বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারী আরও ৩টি পণ্য জিআই সনদ দেয়া হয়েছে। এগুলি হলো রাজশাহীর মিষ্টি পান, যশোরের খেজুরের গুর ও জামালপুরের নকসী কাথা। এ নিয়ে বাংলাদেশে অনুমোদিত জিআই পণ্যের সংখ্যা দাঁড়াল ৩১টি।
সূত্রটি বলছে, আমাদের আরও অনেক উপাদান রয়েছে যেগুলির সাথে বাঙালিত্বের যোগসূত্র রয়েছে। আমরা যে বাঙালী তার সূচক হিসেবে আরও যেসব উপাদান বাংলার মাঠে প্রান্তরে, আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেগুলিও খুঁজে বের করে গুরুত্ব অনুসারে ‘জিআই’ স্বত্ব বা ‘ভৌগলিক নিদর্শন’ করার দাবি রয়েছে পর্যবেক্ষক মহলের।
উল্লেখ্য, ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম ও গাইডলাইন অনুসরণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মৌলিক পণ্যগুলোর জিআই স্বত্ব নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২০১৫ সালে প্রথম জামদানি শাড়ির জিআই স্বত্বের আবেদন জানায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন।