/ খুলনাঞ্চলে ব্যাপকভাবে নিধনের ফলে বিপন্ন হতে চলেছে পরিবেশবান্ধব শামুক

খুলনাঞ্চলে ব্যাপকভাবে নিধনের ফলে বিপন্ন হতে চলেছে পরিবেশবান্ধব শামুক

গাজী মনিরুজ্জামান: দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জলাভূমি এবং কৃষিজমি থেকে পরিবেশবান্ধব জলজপ্রাণী শামুক ব্যাপকভাবে সংগ্রহ করে নিধন করা হচ্ছে। বিভিন্ন বয়সী নিম্ন আয়ের মানুষ জলাশয়, পুকুর, ডোবা, জলাভূমি, ধানক্ষেত এবং খাল থেকে প্রাকৃতিক ফিল্টার শামুক সংগ্রহ করে টাকার বিনিময়ে গলদা চিংড়ি ও পাঙ্গাস ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি করছে। এছাড়া হাঁসের খাবার হিসেবেও শামুক ব্যবহৃত হয়।

ডুমুরিয়ার স্থানীয় ফড়িয়া (শামুক ব্যবসায়ি) হানিফ সরদার বলেন, সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে তিনি শক্ত খোলসযুক্ত শামুক ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে কেনেন, তারপর নারী শ্রমিক দিয়ে ভেঙ্গে ভেতরের মাংস ঘের মালিকদের কাছে ৪৫-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন।
অন্যদিকে, দালালরা শ্রমিকদের কাছ থেকে শক্ত খোলসযুক্ত এক বস্তা (২৫ কেজি) শামুক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় কিনে গলদা চিংড়ি ও পাঙ্গাস খামারে নিয়ে যায় এবং বস্তা প্রতি ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকায় বিক্রি করে।

স্থানীয় লোকজন জানান, বর্ষা ও শরৎকালে শামুকের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, যখন অন্যান্য কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব কম থাকে। ব্যবসায়ীরা তাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলিতে করে জেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ঘুরে শামুক কিনে নেন। একদিনের সংগ্রহের পর, শামুকগুলিকে ট্রলার বা ট্রাকে করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাঠানো হয়।

খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, ফুলতলা, তেরখাদা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ উপজেলা, সাতক্ষীরার তালা, আশাশুনি, দেবহাটা, কালীগঞ্জ উপজেলা এবং বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট, মোল্লাহাট, মোরেলগঞ্জ, কচুয়া, রামপাল উপজেলার নিম্ন আয়ের মানুষরা জীবিকা নির্বাহের জন্য শামুক সংগ্রহের সাথে জড়িত।
অপরদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় শামুকের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, ছোট ও ডিমওয়ালা শামুক আহরণের কারণেও সংকটে পড়েছে নিরীহ এ জলজ প্রাণীটি। এছাড়া বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য লবণ পানি ব্যবহারে শামুকের বংশ বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ডুমুরিয়া উপজেলার স্থানীয় বিল থেকে শামুক সংগ্রহকারী গৃহবধু সুলতা রানী বলেন, শামুক বিক্রি করে তিনি কোনও বিনিয়োগ ছাড়াই প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন। তিনি বলেন, এ মৌসুমে শ্রমিকের কাজ না থাকলেও তিনি শামুক সংগ্রহ করে তার ছেলে-মেয়ে নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে ভাল আছেন।

ডুমুরিয়া উপজেলার গলদা চিংড়ি খামারের মালিক মাহাতাব হোসেন বলেন, “আমার গলদা চিংড়ি খামারে শামুকের মাংস ব্যবহার করা হয় কারণ এর সহজলভ্যতা এবং দাম কম।” মাহতাব আরও বলেন, “তাছাড়া, শামুকের মাংস গলদা চিংড়ি দ্রুত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।”

শামুক নিরীহ জলজ প্রাণী এবং তাই জলাভূমি থেকে সহজেই সংগ্রহ করা যায়, যেখানে তারা প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। এরা ধানক্ষেতের ছোট পোকামাকড়,জোঁক খায়,পানি পরিষ্কার রাখে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষিকা সাবেরা খাতুন বলেন,মাছের ঘেরের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে, প্রাকৃতিক মাছের খাদ্য হিসেবে শামুকের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিটি ধানক্ষেত এবং জলাভূমি থেকে টন টন শামুক আহরণ করে ঘেরে বস্তায় ভরা হয়।

“বর্তমানে জেলায় শামুক সংগ্রহ একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে কারণ এর চাহিদা বেশি। কোন অর্থ বিনিয়োগ ছাড়াই যে কেউ এই ব্যবসা শুরু করতে পারে কারণ আমাদের জলাভূমিতে প্রচুর পরিমাণে শামুক পাওয়া যায়।”

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, “শামুক জল দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে। শামুকের খোলসগুলিতে ক্যালসিয়াম কার্বনেট থাকে যা জমির অম্লতা নিয়ন্ত্রণ করে।” ড. দিলীপ দত্ত আরও বলেন,“শামুকের ব্যাপক ধ্বংস ফসলি জমিকে অম্লীয় করে তুলবে এবং সমগ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী এবং বাস্তত্মুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।”

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) উপ-পরিচালক মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, “শস্যক্ষেত্রের মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে শামুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এর ফলে শামুক দেশে কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। তাছাড়া শামুক পাখি, ইদুর এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রাকৃতিক খাদ্য। এর ধ্বংসের অর্থ বাস্তত্মুতন্ত্র থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে বিলুপ্ত করা।” নজরুল ইসলাম দেশের জলাভূমি এবং জলাভূমি থেকে বৃহৎ পরিসরে শামুক সংগ্রহ নিষিদ্ধ করার জন্য একটি নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার উপরও জোর দেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, পরিবেশে সম্পুর্ণ নিজস্বতা নিয়ে টিকে থাকলেও নানা কারণে শামুক কমে যাচ্ছে। যেমন-প্রজননের সময় শামুক সংগ্রহ ও বিক্রি, গলদা চিংড়ি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার, চুন তৈরী, ডিমওয়ালা শামুক নিধন, শামুকের আবাসস্থল কমে যাওয়া, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, হাঁসের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার, কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, ছোট শামুক বিনষ্ট, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় শামুক বিপন্ন হয়ে পড়েছে।