“কেউ জন্ম থেকে মাদকাসক্ত হয় না। জীবন-সংগ্রামের নানা ব্যর্থতা, হতাশা ও কু-প্রবণতার সুযোগ নিয়ে একসময় মাদকের শিকারে পরিণত হয় তারা। কিন্তু সমাজের চোখে তারা অপরাধী। ঘৃণা ও বঞ্চনার এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু তাদের আরও অন্ধকারে ঠেলে দেয়।”—মাদকবিরোধী সমাবেশে এ কথাগুলো বলেছেন কেএমপি’র (গোয়েন্দা) সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ও ‘সোনামুখ পরিবার’-এর প্রতিষ্ঠাতা এ এম কামরুল ইসলাম।
শুক্রবার (২৫ জুলাই) রাত ৮টায় খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার থুকড়া বাজার বটমূলে বিল ডাকাতিয়া সংগ্রাম ঐক্য জোট আয়োজিত মাদকবিরোধী আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, “একজন মাদকাসক্ত অসুস্থ। সুচিকিৎসা ও সমাজের ভালোবাসা পেলে তারা স্বাভাবিকে ফিরতে পারে। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থায় তাদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়, যা ভালো থেকে মন্দই বেশি বয়ে আনে। মাদকের গ্রাস থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টা নয়, আমাদের মানবিকতার চর্চা বাড়াতে হবে।”
সভায় বক্তারা জানান, সম্প্রতি থুকড়ায় দুই যুবকসহ খুলনায় মোট ১০ জন বিষাক্ত মাদক সেবনে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। আরও কয়েকজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা যুবক।
থুকড়ার বাসিন্দা মকবুল শেখের (ছদ্মনাম) চোখে এখনও আতঙ্কের ছাপ। মাত্র ২২ বছরের ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি। মাদকাসক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই করছিলো ছেলেটি। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার চেষ্টা করেও কোনো ফল হয়নি। তিনি বলেন, “সন্তানের কষ্টে আমি চোখের পানি ফেলতে পারিনি। সমাজের লজ্জা আর ঘৃণা ছেলের চিকিৎসা করাকে কঠিন করে দিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত ছেলেকে হারালাম।”
সভায় সভাপতিত্ব করেন বিল ডাকাতিয়া সংগ্রাম ঐক্য জোটের সদস্য সচিব বি এম সামিউল ইসলাম। তিনি বলেন, “আমরা আর কোনো মায়ের কান্না দেখতে চাই না, কোনো পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ যেন আর না ওঠে। এ জন্য মাদকের বিরুদ্ধে সংগঠনটি সর্বদা সোচ্চার থাকবে।”
সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন রঘুনাথপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এস আই ইব্রাহিম, ডা. আলমগীর হোসেন, আব্দুল হামিদ বিশ্বাস, মো. রমজান গাজী, মো. মফিজুর রহমান, মোহাম্মদ নাজমুল বিশ্বাস, মোজাফফর হোসেন ও মুস্তাকিম বিল্লাহ। সমাবেশটি সঞ্চালনা করেন গোলাম রব্বানী শেখ।
প্রধান অতিথি এ এম কামরুল ইসলাম বলেন, “মাদক নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিকভাবে না করলে এটি জাতীয় নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সমাজের মানসিকতা। মাদকাসক্তদের আমরা অপরাধী হিসেবে দেখি। অথচ তারা অসুস্থ। সুচিকিৎসা, পেশাগত পুনর্বাসন ও পারিবারিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, জেলার বেশিরভাগ মাদকাসক্ত চিকিৎসা নিতে আসে না বা আসতে চায় না। কারণ পরিবার তাদের লুকিয়ে রাখে, সামাজিক লজ্জা ও আইনি জটিলতার ভয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রের দ্বারস্থ হয় না। সরকারি মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্র সীমিত হওয়ায় অনেককেই বেসরকারি ডি-অ্যাডিকশন সেন্টারে যেতে হয়, যেখানে চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং অনেক ক্ষেত্রে অমানবিক আচরণের অভিযোগ রয়েছে।
সামাজিক সংগঠনগুলোর নেতারা জানান, মাদকাসক্তদের শুধু আইনের কঠোর শাস্তি দিয়ে সমাজের মূল স্রোতে আনা সম্ভব নয়। দরকার চিকিৎসা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে সহজ ও মানবিক করা।
সভা শেষে স্থানীয়রা শপথ নেন—থুকড়ায় নতুন করে কোনো প্রাণ যেন মাদকের কারণে না ঝরে। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, পারিবারিক নজরদারি ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন তারা।