রঞ্জু আহমদ : খুলনার চার ৯ উপজেলায় তীব্র সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে মানুষ। বছরের ৬ মাস তাদের এ কষ্ট স্বীকার করতে হয়। পানি সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা কাজে আসে না। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোনোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
পানি কষ্টে থাকা স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে-বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ভালো ভাবে পানযোগ্য পানি পেয়ে থাকে। বাকি ৬ মাস তাদের পানির জন্য সংগ্রাম করতে হয়। খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা উপজেলা, সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলা এবং বাগেরহাটের রামপাল, মোংলা ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলার মানুষ বেশি পানির কষ্টে ভোগে।
এসব এলাকায় পানি সমস্যা সমাধানে স্বল্প মেয়াদী উদ্যোগ আরও দুর্ভোগ বাড়িয়েছে মানুষের। স্থাপন করা হয়েছে পিএসএফ ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মত প্লান্ট। স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণে দায়ভার তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে এগুলো নষ্ট হয়েছে দ্রুত। পরে সেগুলো আর মেরামত বা সংরক্ষন করা হয় না। সরকারি এসব উদ্যোগের কারণে স্থানীয় মানুষ পানি সংরক্ষনে নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহারেও আগ্রহ হারাচ্ছে। ফলে কষ্ট লাঘব হচ্ছে না। এছাড়া এনজিওগুলো পৌর এলাকায় ওভারহেড ট্যাংকের মাধ্যমে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ, রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট, বায়ো স্যান্ড ফিল্টার বসানোর পর সেগুলোও নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতিনির্ভর টেকসই প্রকল্প গ্রহণ না করায় এর সুফল পাচ্ছে না মানুষ।
খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার ৬৭ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি ব্যবহার করতে পারে। বাকি ৩৩ শতাংশ মানুষকে নিজস্ব পদ্ধতিতে পানির জোগান দিতে হয়। তবে সরকারি এ হিসেবের সাথে একমত নন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা।
সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আকমল হোসেন জানিয়েছেন- জেলায় ১ হাজার ৮৪৮টি নলকুপ চালু রয়েছে। যেগুলো দিয়ে সুপেয় পানি উত্তোলন করা হয়। এছাড়া ২ হাজারের মত রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ও পিএসএফ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একই সাথে জেলার সুপেয় পানি সমস্যা সমাধানে দাকোপে আরও ফিল্টার স্থাপন, দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে কমিউনিটি ভিত্তিক ১৫ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্লান্ট স্থান করা হচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে ওই এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কিচুটা কমবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং স্থানীয় মানুষের অসচেনতায় পিএসএফ এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষনাগারগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে দাকোপের তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ায় একটি পিএসএফ স্থাপন করে দুস্থ্য স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে)। স্থানীয়রাই এটির দেখাশোনা করতো। দুইবছর পর ২০২০ সালের ঘুর্ণিঝড় আম্ফানে পুকুরটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপর থেকে সেটি বন্ধ রয়েছে। মানুষের পানির জন্য এখন মজা পুকুরের পানিই পান করতে হচ্ছে।
২০১১ সালে কয়রার বাগালী ইউনিয়নের বাঁশখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটি পিএসএফ বসায় জেজেএস। ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট একই স্কুলে দুই হাজার লিটার ধারণক্ষমতার রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করে একই বেসরকারি সংস্থা। বর্তমানে এই দুটি পদ্ধতি থেকে আর পানি পাচ্ছে না মানুষ। এগুলো রক্ষনাবেক্ষন না করায় দুটোই নষ্ট হয়েছে।
এই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার বলেন-আমাদের বাড়ি থেকে বাঁশখালী স্কুল প্রায় ৫ কিলোমিটার দুরে। প্রথম দিকে আমরা ভালো পানি পেতাম। তবে এখন ওই সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা এখন এলাকার পুকুরের পানি খাই।
দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন-আমাদের এলাকায় চারিদিকে (নদীর পানি) পানি। তবে খাবার পানি আনতে হয় ৮ কিলোমিটার দুরের একটি নলকুপ থেকে। সরকার যে উদ্যোগই নেয় প্রতিবছরের ঝড়ে তা নষ্ট হয়ে যায়। লবন পানির ব্যবহারের কারণে এলাকার নারী ও শিশুদের মধ্যে রোগ বাড়ছে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় কেউ কাউকে সাহায্য পর্যন্ত করতে পারে না।
পানি সমস্যা নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা এওসেড। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক শামীম আরেফিন বলেন-এ অঞ্চলে প্রতি তিন কিলোমিটাররের মধ্যে পরিবেশ এবং প্রতিবেশ পরিবর্তন হয়। একইভাবে ভুগঠনও ভিন্ন। পৃথিবীতে এমন অবস্থা আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। শুধু পানি নয় আরও সমস্যা রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। মানুষের সমস্যা সমাধানে সরকারি বেসরকারিসহ সব দপ্তরের সমন্বয়ে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাহলে অর্থের অপচয় হবে না এবং মানুষ সুফল ভোগ করতে পারবে।