/ খুলনার তিন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসিবিহীন

খুলনার তিন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসিবিহীন

তালিকায় যুক্ত হলো প্রাইভেট
বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ ওয়েস্টার্ন

এম এ হাওলাদার: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(কুয়েট) এবং খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এবার খুলনার আর একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিও ভিসিবিহীন হয়ে গেলো। গতকাল শনিবার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর(ভিসি) প্রফেসর ড. শেখ মোঃ এনায়েতুল বাবর পদত্যাগ করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও নর্থ ওয়েস্টার্নের ভিসি পদত্যাগপত্র লিখেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী চ্যান্সেলরের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার কথা। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে পাওয়া যায়নি পদত্যাগ করা ভিসি প্রফেসর ড. শেখ মোঃ এনায়েতুল বাবরকে। তবে জুন ক্লোজিংয়ের এক সপ্তাহ বাকী থাকলেও এভাবে একের পর এক ভিসিবিহীন হয়ে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম আকারে আর্থিক সংকটে পড়বে বলেও আশংকা সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের দীর্ঘ ১০ মাস পর পদত্যাগ করেন আওয়ামী লবিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত খুলনা নর্থ ওযেস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. শেখ মোঃ এনায়েতুল বাবর। এর আগে একাধিকবার শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন মহলে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও কোন ফল হয়নি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীরা এক দফার আন্দোলন শুরু করে ভিসি ও রেজিস্ট্রারের দপ্তরে তালাবদ্ধ করে দেওয়াসহ তাদেরকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এরপর গতকাল শনিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠান ভিসি।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী তাশিক জানান, এখন থেকে অধ্যাপক ড. শেখ মোঃ এনায়েতুল বাবর আর নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ভিসি নেই। তবে ভিসির ব্যবহৃত মোবাইলে একাধিকবার রিং দেওয়া হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। সামাজিক মাধ্যম থেকে তার স্বাক্ষরিত একটি পদত্যাগপত্র পাওয়া যায়। অর্থাৎ ভিসির পদত্যাগের পর এখন খুলনার বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও অভিভাবকশূণ্য হয়ে পড়লো।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল সংলগ্ন নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিটি বর্তমানে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে রয়েছে। রূপসা সেতু বাইপাস সড়কের পাশের স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল। এজন্য বেশকিছুদিন ধরে শিক্ষার্থীরাও অস্থায়ী ক্যাম্পাসের সামনে বিক্ষোভও করে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাড়া দেননি ভিসিসহ কর্তৃপক্ষ। এছাড়া উক্ত ভিসির বিরুদ্ধে রয়েছে আওয়ামীকরণ করা ছাড়াও নানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ। এমনকি তিনি বিগত জুলাই-আগষ্টের আন্দোলনের একজন সরাসরি বিরোধী ব্যক্তি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ কিভাবে একজন ফ্যাসিস্ট হয়েও এতোদিন তার পদে থাকেন সেটিই প্রশ্ন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে নিয়োগ পূর্ববতী সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে প্রেরিত তার জীবন বৃত্তান্তেই উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগ রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু পরিষদ, খুলনা মহানগর কার্যনির্বাহী কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য।
সূত্রটি জানায়, খুলনা নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে উপাচার্য হিসেবে হিসেবে নিয়োগদানের পূর্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে প্রেরিত তাঁর প্যানেল প্রাথমিকভাবে বাদ পড়ে। পরে আওয়ামী লবিংয়ে তিনি এককভাবে ভিসি মনোনীত হন।
এদিকে, শিক্ষার্থীরা গত বৃহস্পতিবার ভিসি ও রেজিস্ট্রারের দপ্তরে তালা মেরে দিয়ে তাদের দু’জনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলেও শুধুমাত্র ভিসি পদত্যাগ করেন। কিন্তু রেজিস্ট্রারের বিষয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি।
এর আগে গত ২২ মে থেকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের(কুয়েট) এবং ৪ মে থেকে খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও ভিসিবিহীন রয়েছে।

অপরদিকে, সম্প্রতি নগরীর নিরালা আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডের ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম চলমান থাকা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির সাইনবোর্ড পর্যন্ত ঝড়ে পড়ে গেছে। সম্প্রতি ওই বহুতল বিশিষ্ট ভবনটিতে একটি রেস্টুরেন্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাদের রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডই সেখানে শোভা পাচ্ছে। সাধারণত: বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এটি একটি রেস্টুরেন্ট। কিন্তু ভেতরে কয়েকটি ফ্লর নিয়ে চলছে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে এখনও অনেক সময় প্রয়োজন। জমি অধিগ্রহন, অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে অনেক কাজ এখনও বাকী। কিন্তু এরই মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর মেয়াদ শেষে গত ৩০ এপ্রিল সর্বশেষ কর্মদিবস শেষে বিদায় নেন অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মাহবুবুর রহমান। এসময় তিনি রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্ব দিয়ে যান রেজিষ্ট্রার এসএম আবু নাসের ফারুকের ওপর। কিন্তু আর্থিক কোন বিষয়ে স্বাক্ষর করার ক্ষমতা নেই তার।
খুলনা-মংলা রেল সেতু সংলগ্ন কেএমপির লবণ চরা থানার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৫০ একর জমিতে খুলনা শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। যেটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের জুন মাসে। পরে গত ১৩ এপ্রিল নাম পরিবর্তন করে করা হয় খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ভিসি ও প্রকল্প পরিচালক(পিডি) নিয়োগ না হওয়ায় জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে অন্য কোন কাজই করা সম্ভব হবে না। তবে ইতোমধ্যে ২০২৩ সালে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা কেডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জলমা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দু’বছরের জন্য এনওসি(নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নেওয়া হয়। অর্থাৎ চলতি বছরের(২০২৫) মধ্যে ভিসি ও পিডি নিয়োগের পাশাপাশি পরিকল্পনা কমিশন থেকে জিও করা না হলে আবারও পিছিয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ কাজ। এজন্য ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়া যত দেরি হবে ততই শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর বিষয়টিও পিছিয়ে যাবে বলেও আশংকা সংশ্লিষ্টদের।
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত মাস (মে) থেকে নেই ভিসি। এজন্য রুটিন দায়িত্বে থাকা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রারের আর্থিক ক্ষমতা নেই সবকিছু করার। যে কারণে মে মাসের বেতন যেমন হয়নি তেমনি সেখানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাননি ঈদ-উল-আযহার বোনাসও। এখন জুন ক্লোজিং সামনে থাকায় আরও ভয়াবহ সংকটে পড়তে যাচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সূত্রটি বলছে, ভিসি নিয়োগের জন্য গত ১৬ জুন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কার্যালয়ে বৈঠক হয়। চারজন প্রার্থীর মধ্য থেকে একজনের নাম চূড়ান্ত করে পাঠানো হয় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে। সেখান থেকে প্রস্তাবনা চূড়ান্ত হয়ে যাবে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে। এরপরই প্রজ্ঞাপন হলে খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে। এ প্রক্রিয়ায় যদি দীর্ঘসূত্রিতা হয় তাহলে কয়েকটি ধাপে সংকটে পড়বে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। চলতি অর্থবছরের মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাসের বিষয়টি যেমন চূড়ান্ত করতে হবে তেমনি অনেক কেনাকাটার বিলও পরিশোধ করতে হবে। তা না হলে আরও সমস্যায় পড়তে হবে।
এছাড়াও খুলনার অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(কুয়েট) বিগত চার মাসেরও বেশি সময় ধরে অচলাবস্থায় রয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে এ অচলাবস্থা হয়। বর্তমানে সেখানে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে। সেখানে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে আগামী মাসের(জুলাই) মাঝামাঝি সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। যেটি সংকট আরও ঘনিভূত করবে বলেও আশংকা সংশ্লিষ্টদের। এজন্য আপদকালীন সময়ের জন্য একজনের ওপর আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া জরুরি বলেও মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক।