ব্যবস্থাপনা জটিলতা দূর
করাই এখন মূল দাবি

রফিউল ইসলাম টুটুল ঃ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে খুলনার শেখ রাসেল ইকো পার্ক। শহরের কোলাহল ও যান্ত্রিকতা ছেড়ে ক্ষনিকের জন্য হলেও প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার অন্যতম স্থান এখন এ পার্কটি। পুরো এলাকাটি পরিণত হয়েছে সবুজ অরণ্যে। তৈরি করা হয়েছে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা। এখানে প্রবেশ করতেই একজন পর্যটক হারিয়ে যাবেন ছায়াশীতল মনোরম পরিবেশে। এখানে লাগানো হয়েছে বনজ, ফলদ ও শোভাবর্ধনকারি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম লেক। পার্কের প্রবেশদ্বারের এক পাশে রয়েছে পার্কিং প্লেস ও অপরপাশে তৈরি হয়েছে প্লাজা। যেখান থেকে পার্কের একটি অবয়ব দেখার সুযোগ পাবেন যারা পুরো পার্ক ঘূরে দেখার সুযোগ পাবেন না তারা। বিশেষ করে বৃদ্ধ, হাঁটা-চলায় অপারগ ব্যক্তি বা প্রতিবন্ধীদের জন্য এটি হতে পারে স্থাপনা।
খুলনা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বটিয়াঘাটা উপজেলার মাথাভাঙ্গা এলাকায় রূপসা নদীর তীরে ৪৩ একর খাস জমিতে নির্মিত হয়েছে পার্কটি। বিভাগীয় প্রশাসনের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ। ইতিমধ্যে প্রকল্পের প্রথম অংশের কাজ শেষ পর্যায়ে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পার্কের প্রবেশ মুখেই বিশাল দৈর্ঘের লেক নির্মান করা হয়েছে। লেকের দু’পাড়ে তৈরি করা হয়েছে ব্লকের তৈরি দেড় কিলোমিটার লম্বা রাস্তা। যার পুরোটাই পরিণত হয়েছে সবুজ অরণ্যে। পার্কের প্রবেশমুখের বাম পাশে তৈরি করা হয়েছে ঝাউবন আর ডানদিকে রয়েছে ঔষুধি বাগান। ঔষুধি বাগানে চালতা, হরিতকি, বহেরা, জামসহ বিভিন্ন প্রকার গাছ লাগানো হয়েছে। এখানে আসা ভ্রমণপিপাসুদের ক্লান্তি দূর করতে তিনটি গোলঘর ও বসার জন্য পাঁচটি বেঞ্চ নির্মান করা হয়েছে। পার্কের শেষ অংশে রূপসা নদীর বেড়ীবাঁধের পাশেই সুন্দরবনের আদলে ম্যানগ্রোভ জোন তৈরি করা হয়েছে। এখানে গোলপাতা, কেওড়া, সুন্দরি, কাকড়াসহ ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বিভিন্ন প্রকার গাছ লাগানো হয়েছে।
প্রকল্পের পরিচালক ও সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মহসিন হোসেন জানান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদকাল ছিল ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় নয় কোটি টাকা। তবে করোনাসহ বিভিন্ন কারনে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২০ সাল থেকে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের বাকী কাজের মধ্যে রয়েছে পর্যটকদের জন্য লেকের মাঝখানে রেষ্টুরেন্ট নির্মাণ, প্রজাপতি বাগান, ওয়াচ টাওয়ার, চিলড্রেনস্ কর্নার ও সীমাআ প্রাচীরের বাকী অংশ নির্মান। এছাড়াও রিভার ক্রুজিংয়ের নদী তীরে একটি গ্যাংওয়ে পন্টুন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। যেখানে পর্যটকবাহী লঞ্চ ও নৌকা ভিড়তে পারবে। অফিস ভবনসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া পুরো এলাকায় বনায়নের কাজ শেষ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যেহেতু এটি ইকো পার্ক তাই এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপর বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বেশকিছু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই পার্ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এগুলো হচ্ছে সৌন্দর্যবর্ধক বাগান, বনজ ও ফলদ এবং ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজনের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় ইকো পার্ক সৃষ্টির মাধ্যমে জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়ন, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সৃষ্টি ও উন্নয়ন, পর্যটকদের চিত্তবিনোদনের জন্য পরিবেশবান্ধব সুযোগ সুবিধা সৃষ্টিকরণ, প্রতিবেশ পর্যটনের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা।
এরই মধ্যে খুলনাসহ আশেপাশের এলাকা থেকে পর্যটকরাও আসতে শুরু করেছেন। এখানে এসে তারাও হচ্ছেন অনেকটা মুগ্ধ। বিশেষ করে সবুজ অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ায় সেখানে ইতোমধ্যে বিকেল থেকেই শুরু হয় পাখির কিচিরমিচির শব্দ। যেটি পর্যটকদের নিয়ে যায় শহুরে কোলাহল পরিবেশ থেকে ভিন্ন এক জগতে।
পার্কে ঘুরতে আসা নগরীর খালিশপুর এলাকার আশিক ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী জানান, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি ঘুরতে এসেছেন। একবোরেই প্রাকৃতিকভাবে গড়ে তোলা খুলনার ভেতরে এমন একটি পার্ক নির্মান করা হয়েছে যা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য আনন্দের বলেও উল্লেখ করেন তিনি। পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ হলে প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটানোর একটি চমৎকার স্থানে পরিণত হবে এটি। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নয়নের দাবি জানান তিনি। বিশেষ করে খানজাহান আলী সেতুর নিচ থেকে শুরু করে পার্ক পর্যন্ত রাস্তাটির চরম বেহাল দশার কথাও তুলে ধরেন তিনি। পুরো রাস্তাটি খানা খন্দকে ভরা। এই রাস্তার পাশেই রয়েছে র‌্যাব ও নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনা। তারপরও রাস্তাটির উন্নয়নে নজর নেই কর্তৃপক্ষের। পার্কে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটির মেরামত করা না হলে এখানে আসতে পর্যটকদের অনীহা বাড়বে।
কথা হয় সানজিদা ইসলাম নামে একজন গৃহবধুর সাথে। তিনিও তার স্বামী, সন্তানদের সাথে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন এখানে। নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা পার্কটির পরিবেশে দারুণ মুগ্ধ তিনি। তবে এখানে ঘুরতে আসা মানুষদের জন্য নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার অভিমত দিয়েছেন তিনি।
অবশ্য সড়কের বেহাল দশার ব্যাপারে কথা হয় এলজিইডি’র তৎকালীন বটিয়াঘাটা উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার রেজওয়ানুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এটা পাওয়া মাত্রই দ্রুত রাস্তার সংস্কার কাজ শুরু হবে। এরপর রাস্তাটির পূন:র্নিমাণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
পার্কের প্রকল্প পরিচালক বলেন, এই মুহূর্তে বনবিভাগের ১৩ জন বন প্রহরী দিয়ে সার্বিক নিরাপত্তা ও নির্মাণ কাজের দেখাশোনা করানো হচ্ছে। তবে পার্কটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালুর আগেই পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনার কাজটি চূড়ান্ত করতে হবে।
কিন্তু এটির ব্যবস্থাপনা কার হাতে থাকবে সে ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ইতোমধ্যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি পার্কের জমির মালিকানা বন বিভাগের কাছে হস্তান্তরের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছে। যেখানে আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যে বিষয়টি ইতোমধ্যে বন বিভাগের পক্ষ থেকে পত্র দিয়ে খুলনা জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।
কথা হয় ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব সুন্দরবন(টোয়াস)এর সাধারন সম্পাদক এম নাজমুল আজম ডেভিডের সাথে। তিনি বলেন, শেখ রাসেল ইকো পার্কটি পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হলে এটি এ অঞ্চলের পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে এবং ওই এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও অনেকটা গতিশীল হবে। তবে তিনি বলেন, পার্কটির ব্যবস্থাপনায় অংশীজনসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থাকে যুক্ত করা হলে বিভিন্ন পরামর্শের মাধ্যমে পার্কটিকে একটি টেকসই পর্যটন বান্ধব পার্কে পরিণত করা সম্ভব। অবশ্য পার্কটিকে আরও জনবান্ধব করার জন্য তিনি বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের আহবান জানান। তা’ না হলে পার্কটির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে বলেও তিনি মনে করছেন।
যদিও খুলনার জেলা প্রশাসক ও শেখ রাসেল ইকোপার্ক ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি খন্দকার ইয়াসির আরেফিন বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই বিষয়টি সমাধান হয়ে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের আওতায় সেখানে টিকিট সিস্টেমে দর্শনার্থী প্রবেশের ব্যবস্থা করা হবে। এর বাইরেও বন বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পর্যটন কর্পোরেশনসহ যে যে সংস্থা এটি নিয়ে কাজ করছে সকলের সাথে সমন্বয় করে জেলা প্রশাসনই পার্কটি পরিচালনা করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।