স্টাফ রিপোর্টার ঃ রাত আটটা ৫০ মিনিট। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এর ঢাকা মেট্রো-শ-১৩-১৪১১ নম্বরের রেফ্রিজারেটর ভ্যানটি পৌঁছে নগরীর শামসুর রহমান রোডস্থ স্কুল হেলথ ক্লিনিকের সামনে। গাড়িটি দেখেই খুলনার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং করোনা ভ্যাকসিন বিষয়ক কমিটির সদস্যবৃন্দ এগিয়ে আসেন। আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন বেক্সিমকো কোম্পানীর স্থানীয় প্রতিনিধিরা। গাড়িতে থাকা বেক্সিমকোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে মডার্নার একে একে ২২টি কার্টুন বুঝিয়ে দেন সিভিল সার্জন কার্যালয় ও ভ্যাকসিন বিষয়ক কমিটির সদস্যদের হাতে। এরপর আবারো গাড়িটি রওয়ানা দেয় বরিশালের উদ্দেশ্যে। এভাবেই খুলনায় এসে পৌঁছায় মডার্নার ২৬ হাজার ৪শ’ টিকা। খুলনার সিভিল সার্জন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা কোভ্যাক্স সুবিধায় পাওয়া মডার্নার এ টিকা আরও পর্যায়ক্রমে আসবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার আলোকে শুধুমাত্র সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নির্দিষ্ট বয়সী মানুষদেরকে দেয়া হবে এ টিকা। এভাবেই পর্যায়ক্রমে সকলকে টিকার আওতায় আনা হবে বলেও তিনি জানান।
মডার্নার টিকা গ্রহণকালে সেখানে সিভিল সার্জনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন, ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা: শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন। এছাড়া বেক্সিমকো ফার্মাাসিউটিক্যালস লিমিটেড এর আঞ্চলিক বিক্রয় ব্যবস্থাপক(আরএসএম) মো: আজিজুল হক ও এরিয়া ম্যানেজার খান মশিউর রহমানও এসময় উপস্থিত ছিলেন।
বেক্সিমকোর আরএসএম বলেন, সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ ভ্যাকসিনগুলো আনলেও সারাদেশে বিনামূল্যে সরবরাহের দায়িত্ব পালন করছে বেক্সিমকো কোম্পানী। জনস্বার্থে টিকা বিতরণের এ কাজটি করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা: শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, মডার্নার টিকা প্রদান সংক্রান্ত আজ সোমবার প্রশিক্ষণ রয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর বলা যাবে কবে থেকে এগুলো দেয়া হবে। তবে টিকাগুলো তিনি রিসিভ করে স্কুল হেলথ ক্লিনিকের স্টোরে রেখেছেন। কিছু টিকা দেয়া হয়েছে খুলনা সিটি কর্পোরেশনকে।
খুলনার সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, টিকা প্রদান সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ শেষ হলে হয়তো আগামীকাল মঙ্গলবার থেকেই দেয়া শুরু হতে পারে। তবে এ টিকা দেয়া হবে শুধুমাত্র সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাসিন্দাদের। আগে যারা অনলাইনে রেজিষ্ট্রেশন করে রেখেছেন তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ টিকা দেয়া হবে। নতুন যারা রেজিষ্ট্রেশন করবেন তাদেরকেও পরে দেয়া হবে। এছাড়া সিনোফার্ম’র টিকা স্বাস্থ্য এবং বিশ^বিদ্যালয় ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেয়া হচেছ। যা নগরীসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও দেয়া হয় বলে তিনি জানান।
টিকা গ্রহণকালে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পাঁচ সদস্যের কমিটির সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। তারা জানান, সর্বমোট ২৬ হাজার টিকা গতকাল এসেছে। যা দু’হাজার ৬৪০টি ভাওয়ালে রয়েছে। একটি ভাওয়াল থেকে ১০ জনকে টিকা দেয়া যাবে। অর্থাৎ গতকাল যে টিকা এসেছে তা দেয়া যাবে ২৬ হাজার ৪শ’ জনকে।
মডার্নার টিকা দেয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন নির্দেশনার কথা তুলে ধরে সিভিল সার্জন বলেন, দেশের ১২ সিটি করপোরেশন এলাকায় এ টিকা দেয়া হবে। যার অংশ হিসেবে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের জন্য ওই টিকা এসেছে। গর্ভবতী, মাতৃদুগ্ধদানকারী এবং অনূর্ধ্ব ১৮ বছরসহ ছয় ধরনের মানুষ মডার্না এবং সিনোফার্মার টিকা পাবেন না বলেও নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে। কৃষক, শ্রমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিদেশগামী শিক্ষার্থীসহ ২৮ ক্যাটাগরির মানুষ এই টিকা নেওয়ার সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেককে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় হয়ে আসতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা পেতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে নিবন্ধিত হতে হবে।
নতুন নির্দেশনা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রংপুর, সিলেট, বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় মডার্নার টিকা দেওয়া হবে। অন্যদিকে দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দেওয়া হবে সিনোফার্মার টিকা। যেটি বর্তমানে চলমান রয়েছে।
যারা নিতে পারবেন ঃ ১. ৩৫ ঊর্ধ্ব সব জনগোষ্ঠীকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে। এক্ষেত্রে বেশি বয়সি থেকে ক্রমশ কম বয়সি জনগোষ্ঠীকে প্রাধিকার অনুযায়ী এসএমএস দেওয়া হবে। ২. বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা। ৩. নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। ৪. রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য কার্যালয় তথা মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, বিচারিক ও প্রাশাসনিক কার্যালয়গুলোর কর্মর্কর্তা। ৫. প্রতিরক্ষা কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও বর্ডার গার্ড ইত্যাদি বাহিনীর সদস্য এবং কোস্টগার্ড ও প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্ট। ৬. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, ট্রাফিক পুলিশ, আনসার, ভিডিপি। ৭. কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় সরাসরি সম্পৃক্ত সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী (চিকিৎসক, সেবিকা ও মিডওয়াই, এসএসিএমও, অলটারন্টে মেডিকেল কেয়ার, হোমিওপ্যাথি, ফার্মাসিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ল্যাবরেটরি অ্যাটেনডেন্ট, ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ধোপা, টিকিট ক্লার্ক, কুক-মশালচি, পরিছন্নতাবিষয়ক কর্মী, ফিজিওথেরাপিস্ট, অ্যাম্বুলেন্স চালক এবং অন্যান্য সরাসরি সম্পৃক্ত সেবাদানকারী)। ৮. আইনজীবী (বার কাউন্সিল অনুমোদিত)। ৯. গণমাধ্যকর্মী ১০. জনসেবায় সরাসরি সম্পৃক্ত সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মী। ১১. ধর্মীয় প্রতিনিধিগণ। ১২. মৃতদেহ সৎকার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি। ১৩. জরুরি বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কাজের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী। ১৪. নৌ-বন্দর, রেল স্টেশন ও বিমান বন্ধরগুলোতে কর্মরত ব্যক্তি। ১৫. মন্ত্রণালয়, বিভাগ, জেলা ও উপজেলাগুলো আবশ্যকীয় জনসেবায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী। ১৬. নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব আগে নিবন্ধন করবেন কিন্তু এখন পর্যন্ত টিকা পাননি তাদের টিকা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে এসএমএসের মাধ্যমে জানাতে হবে। ১৭. যাদের আগে এসএমএস পাঠানো হয়েছিল কিন্তু কোনো কারণে টিকা নিতে পারেননি তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে ক্রমান্বয়ে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের টিকা দেওয়া হবে। ১৮. অগ্রাধিকারপ্রপ্ত বিদেশগামী বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী (জনশক্তি উন্নয়ন ব্যুরো কর্তৃক অনুমোদিত/নিবন্ধিত)। ১৯. সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কালেজের শিক্ষার্থী। ২০. সরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কর্মী, সরকারি ম্যাটস এবং সরকারি আইএইচটি শিক্ষার্থী। ২১. সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীগণ (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রেরিত তালিকা অনুযায়ী)। ২২. বিডার আওতাধীন ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক সরকারি প্রকল্প কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী (যেমন পদ্মা সেতু প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, এক্সপ্রেস হাইওয়ে প্রকল্প, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প)। ২৩. ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার পরিচ্ছন্নতাকর্মী (যারা আগে টিকা পাননি)। ২৪. ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে (এফডিএমএন) জনগোষ্ঠী। ২৫. কৃষক, শ্রমিক। ২৬. সৌদি আরব ও কুয়েতগামী প্রবাসী শ্রমিকদের ফাইজার টিকার জন্য নির্ধারিত ৭ কেন্দ্র সংরক্ষিত থাকবে। ২৭. সৌদি আরব ও কুয়েতগামী ছাড়া অন্যান্য দেশের প্রবাসী শ্রমিকরা উল্লিখিত। ৭ কেন্দ্র ছাড়া অন্য কেন্দ্রে নিবন্ধন করে টিকা নিতে পারবেন। ২৮. বিদেশগামী শিক্ষার্থীরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত হয়ে সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন সম্পন্ন করে টিকার আওতায় আসবে।
যাদের টিকা দেওয়া হবে না ঃ ১. অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সি জনগোষ্ঠী। ২. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা। ৩. টিকা গ্রহণের সময় জ্বর আক্রান্ত বা অসুস্থ ব্যক্তি। ৪. টিকাজনিত অ্যালার্জির ইতিহাস রয়েছে এমন ব্যক্তি। ৫. প্রথম ডোজ গ্রহণের পর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে। ৬. অনিয়ন্ত্রিত দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, যক্ষ্মা, অ্যাজমা/শ্বাসকষ্ট, কিডনি রোগ, ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন এমন ব্যক্তি, ক্যানসার আক্রান্ত এবং স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রয়োজনে নিবন্ধিত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।