# করোনা হাসপাতালে বেড থেকে রোগী বেশি
# দ্বিতীয় ইউনিট চালু এখন সময়ের দাবি

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে সবকিছুই যেন সর্বোচ্চ সংখ্যক। রোগীর সংখ্যা, রোগী শনাক্ত, শনাক্তের হার, মৃত্যু সবই ঊর্ধ্বমুখী। এ হাসপাতালে গতকাল সর্বোচ্চ সংখ্যক অর্থাৎ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। যেটি এই হাসপাতালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত এই প্রথম। বাড়ছে রোগী, বাড়ছে অতিরিক্ত বেডও। কিন্তু বাড়ছে না কেবল ডাক্তার, নার্স, কর্মচারীসহ জনবল। মাত্র একশ’ বেডের উপযোগী করেই যেখানে পাইপ লাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়েছিল। সেখানে অতিরিক্ত বেডগুলোর রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ শুধুমাত্র সিলিন্ডারের ওপর নির্ভরশীল। এ অবস্থায় দিন যতই যাচ্ছে করোনা হাসপাতালের রোগী, ভিজিটর, ডাক্তার, নার্স, কর্মচারী সকলেই যেন হাঁফিয়ে উঠছেন। অর্থাৎ খুলনা করোনা হাসপাতালে বেড থেকে রোগী বেশি থাকায় দ্বিতীয় ইউনিট এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা বিষয় নিয়ে খুলনায় রয়েছে একাধিক কমিটি। প্রতিনিয়তই হচ্ছে বিভিন্ন সভা আর গ্রহণ করা হচ্ছে নানান কর্মসূচি। কিন্তু করোনা হাসপাতালের দ্বিতীয় ইউনিট করার বাস্তবতা এখনও অনিশ্চিত। নেই জনবল পদায়নেরও কোন পদক্ষেপ। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সার্বিক সমন্বয়কারী, খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ এবং খুলনা বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজের মাও করোনায় আক্রান্ত। তাকে রাখা হয়েছে নার্সদের কক্ষে। যেটি স্টোর রুম হিসেবে রাখা হয়েছিল। করোনা হাসপাতাল করার পর সেটিকে নার্সদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু জায়গা না থাকায় সেটি এখন রোগীর কেবিন।
করোনা হাসপাতালের মুখপাত্র ও খুমেক হাসপাতালের আরএমও ডা: সুহাস রঞ্জন হালদার গতকাল বললেন, অবস্থা এমন যে, এখন আর কোন ভিআইপি’র জন্যও এ হাসপাতালে জায়গা দেয়ার সুযোগ নেই।
করোনা হাসপাতালে একবার ভর্তি হলে কমপক্ষে ১৪ দিন পর দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল হলেই তাকে ছাড়পত্র দেয়ার কথা। কিন্তু রোগীর চাপের কারণে এক সপ্তাহ পার হওয়ার পরই রোগীর অবস্থা একটু ভালো দেখলেই তাকে বাড়ি গিয়ে হোম আইসোলেশনে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। এর পরেও প্রতিদিন যে হারে রোগী ছাড়া হচ্ছে তার চেয়ে অধিক সংখ্যক রোগী ভর্তি হচ্ছেন। গতকাল সকালে বিগত ২৪ ঘন্টার হিসাব দিতে গিয়ে করোনা হাসপাতালের মুখপাত্র জানান, ২৪ ঘন্টায় ছাড়পত্র দেয়া হয় ৩৩জনের, কিন্তু ভর্তি হয় ৪৭জন। আইসিইউ, এইচডিইউসহ করোনা হাসপাতালে গতকাল ১২৯জন রোগী ভর্তি ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিনই এ হাসপাতালে অতিরিক্ত বেড প্রবেশ করাতে হচ্ছে। এতে পরিবেশও অনেকটা ঘিঞ্জির হয়ে পড়ছে। হাসপাতালের অপর সূত্রটি বলছে, গতকাল এ হাসপাতালে ২২ রোগী ভর্তি হলেও ছাড়পত্র দেয়া হয় ১১জনকে।
নিজ মায়ের অসুস্থতার জন্য দৌড়ঝাঁপের পাশাপাশি কলেজ ও করোনা হাসপাতাল সবকিছুই সামাল দিতে হচ্ছে সার্বিক সমন্বয়কারীকে। হাসপাতালের নয়া পরিচালক এখনও সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারেননি। দায়িত্ব নেয়ার সাথে সাথেই রোগীর চাপ প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই করোনার দ্বিতীয় ইউনিট করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন। অবশ্য খুমেক হাসপাতালের বিদায়ী পরিচালকের আমলে সাবেক অর্থপেডিক এবং গ্যাষ্ট্রোলজি বিভাগকে করোনা হাসপাতালের দ্বিতীয় ইউনিট করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এখন সেখানে পাইপ লাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ ও বেড সংযোজন করার পাশাপাশি জনবল দেয়া হলেই দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
জনবল পদায়নের ব্যাপারে সাম্প্রতিক করোনা বিষয়ক জেলা কমিটির মিটিংয়ে বিভাগের অন্যান্য জেলা থেকে ডাক্তার পদায়নের জন্য বলা হয়েছিল। সে সম্পর্কে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা: রাশেদা সুলতানা গতকাল বলেন, করোনা হাসপাতালের জন্য অতিরিক্ত ২১জন ডাক্তার দেয়া হয়েছে। এখন আর ডাক্তার দেয়ার সুযোগ নেই। কেননা, খুলনায় যেমন করোনা রোগী ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণশীল তেমনি অন্যান্য জেলায়ওতো একই অবস্থা। সুতরাং এখন ডাক্তার দিতে হলে ঢাকায় লিখতে হবে। এজন্য খুমেক হাসপাতালের পরিচালক যদি বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বরাবর লিখিত দেন তাহলে তিনি সেটি ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সুপারিশসহ পাঠিয়ে ডাক্তার পদায়নের জন্য লিখবেন।
খুলনা করোনা হাসপাতালে একদিনে ৭ জনের মৃত্যু ঃ সোমবার দিবাগত রাত পৌণে তিনটা থেকে গতকাল মঙ্গলবার রাত পৌণে নয়টা পর্যন্ত বিগত ১৮ ঘন্টায় খুলনা করোনা হাসপাতালে সর্বমোট ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল দুপুরে মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে দু’জনের এবং সন্ধ্যায় ঠিক একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে আরও দু’জনের। করোনা হাসপাতাল থেকে এখন শুধু কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। এক সময় ছিল অক্সিজেন সিলিন্ডার আর ট্রলির শব্দ। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে মানুষের কান্না। হাসপাতাল এলাকার পরিবেশ কেমন যেন ভারী থাকছে সব সময়।
হাসপাতালের সূত্রটি বলছে, গতকাল প্রথম প্রহরে অর্থাৎ রাত পৌণে তিনটার দিকে মৃত্যু হয় মো: সেলিম জমাদার(৬৫) নামের এক রোগীর। তিনি বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার কেয়ার বাজার এলাকার বাসিন্দা। করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে গত ৫ জুন এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
গতকাল সকাল সোয়া সাতটায় মৃত্যু হয় আ: মালেক(৭৫) নামে একজনের। তিনি খুলনার ফুলতলার রাড়ীপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তাকেও ৫ জুন ভর্তি করা হয়েছিল এ হাসপাতালে।
গতকাল দুপুর পৌণে একটায় মৃত্যু হয় তুষার কান্তি(৫৮) নামের এক রোগীর। তিনিও ফুলতলার বানিয়া পুকুর এলাকার বাসিন্দা। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল ৪জুন।
খুলনার কয়রার ষোল হালিয়া এলাকার বাসিন্দা আয়জান বেগম(৭৫) গতকাল দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল ৬ জুন।
গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে এ হাসপাতালে দু’জনের মৃত্যু হয়। এরা হলেন, যশোর সদরের হাজী মহসিন রোডের বাসিন্দা কাজী সাইদুর রহমান(৭৪) এবং বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার বানিয়া খালি এলাকার আ: হাই শিকদার(৮০)। তাদের দু’জনকেই একদিন আগে অর্থাৎ ৭ জুন এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সর্বশেষ গতকাল রাত পৌণে নয়টায় মৃত্যু হয় দরবেশ আলী(৭২) নামের এক রোগীর। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া এলাকার বাসিন্দা। করোনায় আক্রান্ত হলে গতকালই তাকে এ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। কিন্তু একদিন পার হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়।
করোনা রোগী ও মৃত্যুহার যেমন বাড়ছে তেমনি শনাক্তের পর আক্রান্তও এখন ঊর্ধ্বমুখী। গতকালও খুলনা মেডিকেল কলেজের আরটি পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার পর আক্রান্তের হার ছিল ২৯ শতাংশ। কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজ বলেন, গতকাল ২৭৯টি নমুনা পরীক্ষার পর ৮১জনের করোনা শনাক্ত হয়। ২৭৯টি নমুনার মধ্যে খুলনার সংখ্যা ছিল ১৯৩টি। শনাক্ত হওয়া ৮১জনের মধ্যে খুলনার রয়েছেন ৪৯জন। এছাড়া বাগেরহাটের ২৬জন, যশোরের দু’জন, পিরোজপুরের দু’জন, গোপালগঞ্জের একজন এবং ঝিনাইদহের একজন রয়েছেন।
এছাড়া খুলনার সিভিল ডা: নিয়াজ মোহাম্মদ আগের দিনের হিসাব উল্লেখ করে বলেন, জেলায় সর্বমোট ৪৭৯টি নমুনা পরীক্ষার পর ১৫১ জনের করোনা শনাক্ত হয়। অর্থাৎ ওইদিন খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে খুলনার ৩১৫টি নমুনার মধ্যে শনাক্ত হয়েছিল ১১৫জনের। বাকীগুলো খুলনার অন্যান্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের এন্টিজেন পরীক্ষার রিপোর্ট।