এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আওতাধীন পরিচালিত করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের শুরু থেকে বিগত ১৫ মাসে চারশ’ ছাড়ালো মৃত্যু। দিন যতোই যাচ্ছে ততোই যেন মৃত্যুপুরিতে পরিণত হচ্ছে হাসপাতালটি।
এদিকে, স্থান সংকুলান না হওয়ায় খুলনা জেনারেল হাসপাতালের সব রোগী ছেড়ে দিয়ে যেমন আড়াইশ’ বেডের ওই হাসপাতালে মাত্র ৭০টি করোনা রোগী ভর্তির সুযোগ করে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে, তেমনি শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের আইসিইউর মতো একটি স্পর্শকাতর জায়গায় অন্য রোগীদের বাদ দিয়ে করোনা রোগী রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেখানে অবশ্য অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার পাশাপাশি আলাদা করোনা ইউনিটের যাত্রা হচ্ছে আজ থেকে। মুমূর্ষু রোগীদের চিন্তা না করেও এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে করোনা মহামারীকে সামাল দিতে গিয়ে। পাশাপাশি চলছে লকডাউনও। কিন্তু কমছে না মৃত্যুর মিছিল। করোনা হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের মধ্যে চলছে হাহাকার অবস্থা। প্রতিদিন বেডের বাইরে থাকা রোগীদের অক্সিজেন দিতে সিলিন্ডার নিয়ে হয় কাড়াকাড়ি। কে কার রোগীকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আগে দিতে পারবেন সেই প্রতিযোগিতা চলে। বিশেষ করে রাত যত গভীর হয় এমন হাহাকার পরিস্থিতি ততোই বৃদ্ধি পায় বলে সেখানে অবস্থানরত রোগী ও তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন।
হাসপাতালের মৃত্যুর রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছর এপ্রিল মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে খুলনা করোনা হাসপাতালে মৃত্যু হয় ১৫৬ জনের। তখন হাসপাতালটি ছিল নগরীর নূর নগরস্থ খুলনা ডায়াবেটিক হাসপাতালে। আর এ বছরের গত ছয় মাসে মৃত্যুবরণ করেন ২৪৫জন। এ বছরের শুরু থেকে হাসপাতালটি খুমেক হাসপাতালের অভ্যন্তরের আইসিইউ ভবনে পরিচালিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ এ বছরের বিগত ছয় মাসের গড় হিসাবে দেখা যায়, প্রতি মাসে ৪০জনেরও বেশি রোগীর মৃত্যু হয়েছে এ হাসপাতালে।
এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১২জন, ফেব্রুয়ারিতে দু’জন আর মার্চ মাসে ছয়জনের মৃত্যু হলেও এপ্রিল মাস থেকেই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। অর্থাৎ এপ্রিলে ৫৬জন, মে মাসে ৩৪ জন আর শুধুমাত্র জুন মাসেই মারা যায় ১২৫জন। জুলাইয় মাসের গত দু’দিনে এ হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে ১০জনের।
অবশ্য গত মাসে এ হাসপাতালে মৃত্যুহার যেমন বেড়েছে তেমনি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। যে কারণে একশ’ বেডের হাসপাতালটি সম্প্রতি ১৩০ বেডে উন্নীত করা হয়। কিন্তু এর পরও সংকুলান হচ্ছে না রোগীর। গতকাল সকালেও এ হাসপাতালে রোগী ছিল ২০৪জন। অর্থাৎ বেডের চেয়েও ৭৪জন বেশি।
এদিকে, খুমেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটে সংকুলান না হওয়ায় গত ২০ জুন থেকে এ হাসপাতালের পাশাপাশি খুলনা জেনারেল হাসপাতালেও করোনা রোগী ভর্তি করা হয়। অবশ্য সেখানে মাত্র ৭০টি বেড রয়েছে এবং করোনা শনাক্ত হওয়ার পরই কেবল সেখানে ভর্তি করা হবে রোগী। আর করোনার উপসর্গ থাকলে সে ধরনের রোগীদের কেবল খুমেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটেই ভর্তি করা হচ্ছে। জেনারেল হাসপাতালের সব রোগীদের ছাড়পত্র দিয়ে সেখানে শুধুমাত্র করোনা রোগী ভর্তি কার্যক্রম শুরুর পর সেখানেও প্রায় পরিপূর্ণ থাকছে বেডগুলো। গতকাল সকালেও ওই হাসপাতালে ৬৬জন রোগী ভর্তি ছিল বলে হাসপাতালের মুখপাত্র ডা: কাজী আবু রাশেদ জানিয়েছেন। আর গতকাল পর্যন্ত এ হাসপাতালে মৃত্যু হয় ১৭ জনের।
অবশ্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সী রোগীই বেশি। মৃত্যু তালিকায় ৪০ থেকে ৫০ বছর এবং ৭০ বছরের উপরের বয়সী রোগীর সংখ্যাও প্রায় একই রকম। আর ৪০ বছরের নিচের রোগীর সংখ্যা একেবারেই কম। তবে শেষের দিকে এসে ৪০ বছরের কম বয়সী রোগীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে।
খুমেক করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত এ হাসপাতালে ৪০৪জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মৃত্যু হয় পাঁচজনের। এরা হলেন, নগরীর খানজাহান আলী থানাধীন ফুলবাড়িগেট এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারা খাতুন(৩২), খুলনার রূপসা উপজেলার নন্দনপুরের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম(৬৬), কেএমপির হরিণটানা থানাধীন আরাফাত প্রকল্পের বাসিন্দা নাজমা বেগম(৪৪), যশোর সদর থানাধীন বকচর এলাকার বাসিন্দা মো: শরিফুল ইসলাম(৪২) এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানাধীন ব্রোকাবাদ এলাকার বাসিন্দা সুবর্ণা রানী মন্ডল(৫৬)।
অবশ্য করোনা রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধির ফলে অনেকটা শংকা বিরাজ করছে স্বাস্থ্য প্রশাসনেও। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন-বিএমএ খুলনার সাধারণ সম্পাদক ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজ বলেন, হাসপাতালে যে রোগী ভর্তি হচ্ছে তা দেখেই আমরা শংকিত হয়ে পড়ছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে প্রায় প্রতিটি ঘরেই করোনা রোগী রয়েছে। কেননা এখন প্রায় প্রতিটি ঘরেই জ¦র-কাশির রোগী আছে। একটি পরিসংখ্যানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনার উপসর্গ আছে এমন লোকদের মধ্যে মাত্র চার শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। বাকী ৯৬ শতাংশ লোকই বাসায় বসে চিকিৎসা নিচ্ছে। অর্থাৎ উপসর্গের শতভাগ রোগী যদি হাসপাতালমুখী হয় তাহলে আদৌ তাদেরকে জায়গা দেয়া সম্ভব হবে না। এজন্য জনসচেতনতার কোন বিকল্প নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা: রাশেদা সুলতানা বলেন, গত বছর থেকে শুরু হয়ে গতকাল শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় সর্বমোট এক হাজার ১৩৬জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে বিগত ২৪ ঘন্টায় মৃত্যু হয় ২৭জনের। এছাড়া এ পর্যন্ত বিভাগে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৮ হাজার ৭২১জন। যার মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৩৯ হাজার ৩৫৪জন। অর্থাৎ যে হারে করোনার প্রকোপ বেড়ে চলেছে তা থেকে রক্ষার জন্য জনসচেতনতার কোন বিকল্প নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।