/ খুলনা জেলায় নার্সারী ব্যবসার প্রসার ঘটছে

খুলনা জেলায় নার্সারী ব্যবসার প্রসার ঘটছে

গাজী মনিরুজ্জামান: খুলনা মহানগরী এবং জেলার নয়টি উপজেলায় নার্সারী ব্যবসার ক্রমশ প্রসার ঘটছে। নিজেদের পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ ফল ও সবজির আবাদ করছে। আর ফলদ চারা ও কলমের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জেলায় নার্সারীর সংখ্যাও বেড়েছে।


নার্সারীর ব্যবসা জেলায় অনেকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। কৃষি অর্থনীতিতে নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে। কেউ কেউ শূন্য থেকে লাখপতি হয়েছেন। প্রথমে অন্যের জমি ইজারা নিয়ে নার্সারী গড়ে তুলে পরবর্তি সময়ে নিজে জমি ও বাড়ীর মালিক হয়েছেন। তাদের দেখাদেখি খুলনা জেলার অনেক উপজেলায় ক্ষেতের পর ক্ষেত গড়ে উঠছে নার্সারী।


খুলনা জেলা নার্সারী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু মাসুদ বলেন, প্রায় সব নার্সারীতে হাড়িভাঙ্গা, ল্যাংড়া, আম্্রপালি, হিমসাগর, ফজলি, গৌরমতি, বারি-৪, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, চিয়াংমাই, ব্রæনাই কিং, মিয়াজাকি, ডগমাই জাতের আম, আঠাহীন কাঁঠাল, ভিয়েতনাম ও কেরালার নারকেল, সুপারী, সফেদা, শরিফা, বেদানা, মাল্টা, কুল, কামরাঙ্গা, সেগুন, মেহগনি, শাল, বাবলা, তেজপাতা, দারুচিনি, এলাচ, চালতা, কদবেল, আপেল, কাজুবাদাম, রক্ত চন্দন, শ্বেত চন্দন, পেয়ারা, আঙ্গুর, লিচু, জাম, আপেল, ডালিম, ইউক্যালিপটাস, শিলকড়াই, শিরিষ, নিম, আমড়া, লটকন, চুইঝাল, লবঙ্গ, হরিতকী, বহেরা, অর্জুন, বিভিন্ন জাতের লেবু, মিষ্টি তেঁতুল, অ্যালোভেরা, গোলাপ, ক্যাক্টাস এবং অন্যান্য ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা পাওয়া যায়।


খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, জেলায় নিবন্ধিত নার্সারীর সংখ্যা ৫২টি। অনিবন্ধিত নার্সারীর সংখ্যা ২৩৬টি। অর্থাৎ খুলনা জেলায় মোট নার্সারীর সংখ্যা দাড়ায় ২৮৮টি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নার্সারীর সংখ্যা ৪০০ এর বেশি হবে। তিনি জানান, নিবন্ধন না করলে জরিমানার কোন বিধান না থাকায় অধিকাংশ নার্সারীর মালিক নিবন্ধন করতে চায়না। খুলনা জেলার ফুলতলা ও পাইকগাছা উপজেলায় বেশ কিছু নতুন নার্সারী হয়েছে। সেখান থেকে সারা দেশে বেশিরভাগ চারা সরবরাহ করা হয়।
খুলনা জেলা নার্সারী মালিক সমিতির সভাপতি এস এম বদরুল আলম রয়েল বলেন, মাতৃগুণ বজায় রাখা, দ্রæত ফলন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং অধিক ফলন পেতে অঙ্গজ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে গাছের চারা তৈরীর নাম কলম। এ কলম তৈরীতে রয়েছে নানা নাম ও পদ্ধতি। যেমন- গুটি কলম, শাখা কলম (কাটিং), চোখ কলম বা বাডিং। তবে কলম তৈরীতে গ্রাফটিং বা জোড় কলম, কাটিং বা উপজোড় কলম উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি।


তিনি আরোও বলেন, জেলার নার্সারিগুলিতে প্রায় ২,৫০০ দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। যার একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মহিলা শ্রমিক রয়েছেন। তারা পুরুষ সহকর্মীদের সাথে চারাগাছ পরিচর্যায় তাদের দক্ষতার প্রমাণ দিচেছন।
প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা বেসরকারি নার্সারি থেকে কম দামে চারা সংগ্রহ করে গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারে বিক্রি করে। চাহিদা ও গুণমান অনুসারে একটি চারার পাইকারি মূল্য ৫ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়।


নার্সারী মালিকরা জানান, বছরে চারা বিক্রির মৌসুম হলো দুটি। নভেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বিক্রি হয় বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ। তবে সেটা মূল ব্যবসা নয়। আর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিক্রি হয় বিভিন্ন ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা। মূলত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস সামনে রেখে সারা বছর বিভিন্ন প্রজাতির চারা উৎপাদন করেন নার্সারী মালিকেরা।


ফুলতলা উপজেলা নার্সারী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবুল বাশার বলেন, উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ নার্সারী ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এলাকার মানুষের প্রধান আয়ের উৎসও এটি। তিনি আরও বলেন, “বর্ষাকাল বৃক্ষরোপণের অনুকুল হওয়ায় চারাগাছের চাহিদা বেশি। মানুষ প্রতিদিন বিভিন্ন ফল ও ঔষধি গাছের চারা কিনতে নার্সারিগুলিতে ভীড় করছেন।”


রূপসার করিম নার্সারীর মালিক আব্দুল করিম বলেন, তিনি ৪২ বছর ধরে চারা বিক্রি করছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা। সেই সঙ্গে বিলাতি ঝাল, বেগুন, টমেটোসহ নানান ধরনের সবজির চারাও বিক্রি হয়।


নার্সারীতে চারাগাছ কিনতে আসা নগরীর মুজগুন্নী এলাকার সাদিয়া আক্তার রুমি বলেন, শোভাবর্ধনকারী গাছের পাশাপাশি ঔষধি গাছও লাগিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় একটি নিম গাছও বাড়িতে লাগিয়েছি। এছাড়া অ্যালোভেরা, গোলাপ, ক্যাক্টাস ও বেশ কিছু ফলের গাছও লাগিয়েছি। আমার সংগ্রহে যেসব গাছ আছে, তাতে বাড়ীতে ছোটখাটো একটা নার্সারী তৈরী হয়েছে।


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনা শাখার সমন্বয়কারী এ্যাডঃ মোঃ বাবুল হাওলাদার বলেন, গাছ শুধু অক্সিজেনই দেয়না, এটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে, মাটি রক্ষা করে, জলবায়ূ পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমায় এবং অর্থনৈতিকভাবে মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলে। তিনি আরও বলেন, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে আমাদের সবাইকে বৃক্ষরোপনে এগিয়ে আসতে হবে।


খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ নজরুল ইসলাম জানান, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সরকারও ব্যাপক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় মহাসড়কের পাশে এবং সরকারি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করা হচ্ছে।


তিনি আরো জানান, নার্সারী ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক। কেউ পরিকল্পনা মাফিক নার্সারী করলে অনায়াসে তিনি স্বাবলম্বী হবেন। খুলনার নার্সারীর উৎপাদিত চারা ও কলমের যথেষ্ঠ সুনাম রয়েছে। এছাড়া খুলনাবাসীর বৃক্ষরোপণের আগ্রহ আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেড়েছে। ছাদ বাগানের দিকেও ঝুঁকছেন অনেকে। এভাবে গাছ লাগানো চলতে থাকলে পুরো খুলনা জেলা একসময় সবুজে ভরে উঠবে।