/ গরমে হাঁসফাঁস দেশ, দেখা মিলছেনা বৃষ্টির

গরমে হাঁসফাঁস দেশ, দেখা মিলছেনা বৃষ্টির

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দীর্ঘতর গ্রীষ্ম

আসাদুজ্জামান বিকু: দেশজুড়ে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দিনাজপুরে সর্বোচ্চ ৩৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দাবদাহের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষ কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। এ দাবদাহে শুধু মানুষের স্বাভাবিক জীবনই ব্যাহত হচ্ছে না, বরং কৃষি ও গবাদিপশু খাতেও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, যা অস্থিরতার বীজ বপন করছে দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দীর্ঘ দিনের খরার পরে হঠাৎ ভারি বর্ষণ হলে তা বন্যা ও ভূমিধসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ধরনের বৈশ্বিক জলবায়ু অস্থিরতা বাংলাদেশে ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে দিনাজপুরে, যেখানে তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৩৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অন্যদিকে, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে সিলেটে, মাত্র ২৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এতে দেশের বিভিন্ন জেলার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে। খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা-৩৬.২, যশোরে-৩৬.৫, ও কুষ্টিয়ায়-৩৬.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গরমে হিটস্ট্রোক ও পানিশূন্যতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা গত এক সপ্তাহে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও পুরোনো শারীরিক রোগে আক্রান্তদের মধ্যে গরমজনিত রোগের প্রকোপ বেশি। ডাক্তারদের মতে, অবিরাম গরমে দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা ও পর্যাপ্ত পানি পান না করার কারণে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুসারে আগামী কয়েকদিন দেশের আবহাওয়ায় পরিবর্তন আসতে শুরু করবে। ১৫ জুন রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হতে পারে এবং ঢাকায় বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে, যা সাম্প্রতিক দিনের তুলনায় কিছুটা কম।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৬ থেকে ১৮ জুনের মধ্যে সারাদেশে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বাড়বে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলা অঞ্চলে ভারি বর্ষণের (১০০ থেকে ১৫০ মিলিমিটার) সম্ভাবনা রয়েছে। বজ্রপাতের ঝুঁকিও উচ্চ মাত্রায় থাকবে। এই সময় খোলা জায়গায় থাকা থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধসের আশঙ্কাও রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. এম রফিকুল ইসলাম জানান, গত পাঁচ বছরে জুন মাসের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ষার আগমন গড়ে সাত দিন পিছিয়েছে, যা দেশের কৃষি চক্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘতর গরম ও অনিয়মিত বৃষ্টি কৃষি উৎপাদনে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং কৃষক ও গবাদিপশু পালকদের জীবনমানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দীর্ঘ দিনের খরার পরে হঠাৎ ভারি বর্ষণ হলে তা বন্যা ও ভূমিধসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ধরনের বৈশ্বিক জলবায়ু অস্থিরতা বাংলাদেশে ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। গবাদিপশু ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব মোকাবেলায় সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনগুলোতে এখনো কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। বর্ষার সময় জলাবদ্ধতা ও খরার সময় পানির অভাব এই দুই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিতে পারছি না আমরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ না থেকে দেশে দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজন ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার, পানি ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া বন্যা ও খরার ঝুঁকি কমাতে স্থানীয় সরকারগুলোকে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
গ্রীষ্মকালের অতিরিক্ত গরম এবং বর্ষার অনিয়মিত প্রবণতা এখন দেশের জন্য জলবায়ু সংকটের স্পষ্ট সংকেত। এই সংকট মোকাবেলায় না গেলে খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে মারাত্মক ক্ষতি হবে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এখনই ব্যবস্থা নিলে বড় ধরনের দুর্যোগ এড়ানো সম্ভব, নতুবা ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।