উত্তরসূরীর হাতে প্রাচীন এক পরিত্যক্ত বাড়ির নতুন জীবনের গল্প
মোঃ আনোয়ার হোসেন আকুঞ্জী, নিজস্ব সংবাদদাতা, শাহপুর(খুলনা): মাছ ধরতে গিয়ে ঘুনিতে পাওয়া যেত সোনা-রুপার কড়ি। দীঘি খননে পানি না উঠলে বলি চাওয়া হয় জমিদার বউয়ের। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ বলে রূপকথা। কিন্তু খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া গ্রামের জমিদার বাড়ির দেয়াল, গম্বুজ আর ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই ইতিহাসের জাদুঘরে। বরং এক উত্তরসূরীর হাতে অতীতের ছাইচাপা ঐতিহ্য জ্বলে উঠছে নতুন আলোয়।
রূপকথার জমিদার বাড়ি, যেখানে রাজত্ব করতেন সরদার বংশঃ
ধামালিয়ার জমিদার পরিবারটির শুরু ১৭০০ শতকের দিকে, যখন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর দক্ষিণবঙ্গের একাংশে মুসলিম জমিদারদের প্রভাব বেড়ে যায়। মুন্সী বাবর আলী সরদার ছিলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীতে মুন্সী আহাদ আলী ও মুন্সী ভেকন আলী সরদারের শাসনামলে জমিদারির প্রভাব ও বিস্তার চূড়ান্ত রূপ নেয়। তখনকার কলকাতায় জমিদারদের ইটভাটা, কাঠের ব্যবসা, ঠিকাদারি চালু ছিল। বরুনা বাজারে গড়ে ওঠে নৌবন্দর। এই বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ভেতরেই জন্ম নেয় নানা লোককথা যেমন, বিলের ঘুনিতে মাছ নয়, উঠত রুপার কড়ি!
একটি গল্প এখনো এলাকায় লোকমুখে ঘোরে। ধামালিয়ার পাকা পুকুরে পানি উঠছিল না। এক সাধু বলেছিলেন, বলি দিতে হবে জমিদার আহাদ আলীর স্ত্রীকে। যদিও জমিদার তা প্রত্যাখ্যান করে এনে দেন কলকাতার উজির মিস্ত্রিকে, যার শান বাঁধানো পদ্ধতিতে আজো টিকে আছে সেই পুকুর।
স্থাপত্য যেখানে ইতিহাস বলেঃ
১৭১৭ সালে এই জমিদারি এস্টেট স্বীকৃতি পায়। জমিদার ভেকন আলী নির্মাণ করেন তিন গম্বুজবিশিষ্ট খোদাই করা মসজিদ, যা আজও ধর্মীয় স্থাপত্যের জীবন্ত নিদর্শন। গম্বুজের চূড়ায় পিতলের কলস, দেয়ালে মোগল-ধাঁচের অলংকরণ, এবং কারুকাজের নিপুণতা দেখে বোঝা যায়, এটি কোনো সাধারণ ধর্মীয় ভবন ছিল না। মসজিদের পাশে দু’তলা জমিদার ভবন, যার দক্ষিণ দিকে ছয় কক্ষ, উত্তর দিকে রয়েছে রান্নাঘর, মালঘর ও বিস্তৃত সিঁড়ি। ভবনের পেছনে রয়েছে হাজতখানা কথিত আছে, এখানে গ্রাম্য বিচার হত। দুটি পুকুর এখনো অস্তিত্বে আছে, যার তিন দিক ও তলদেশ শান বাঁধানো।
ভগ্নপ্রায় গৌরবের ফিরে আসা: ড. এসকে বাকারঃ
সময়ের সাথে জমিদারির গৌরব ভেঙে পড়ে—অর্থনৈতিক অবনতি, ব্রিটিশ শাসন, মামলায় পরাজয় এবং জমি বাজেয়াপ্ত করে দেয় পাকিস্তান সরকার। তবে জমিদার পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মে জন্ম নেওয়া ড. শামছুল করিম বাকার যেন এক ইতিহাসের পুনর্জাগরণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনার্সে প্রথম হয়ে যিনি কানাডা ও পরে আমেরিকার ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন, তিনি ৪টি পেটেন্টসহ বিশ্বখ্যাত কোলগেট টুথপাউডারের আবিষ্কর্তা দলের সদস্য ছিলেন।
এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী প্রবাসে থাকার পরেও ভুলেননি গ্রামের সেই ধ্বংসপ্রায় জমিদার বাড়ি। নিজের অর্থায়নে তিনি মসজিদটি সংরক্ষণ করেন, জমিদার বাড়ির একাংশ সংস্কার করেন এবং শুরু করেন এক সামাজিক বিপ্লব।
মানবসেবা, শিক্ষাবিস্তারে জমিদারি থেকে জনদরদীঃ
ড. বাকার শুধুই উত্তরসূরী নন, এক আধুনিক রূপকার। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ড. এসকে বাকার কলেজ, যা এখন এমপিওভুক্ত। রঘুনাথপুর হাইস্কুলে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি ভবন নির্মাণ করেছেন। চালু করেছেন ফ্রি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, হাফেজিয়া মাদ্রাসা, এতিমখানা ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া সরকারি কলেজ ছাত্রাবাস, স্কুল ভবন, সঙ্গীত একাডেমি সবখানেই ড. বাকার নাম জড়িয়ে আছে অনুদানে, পরিকল্পনায়, বাস্তবতায়।
ধামালিয়ার ভবিষ্যৎ ঐতিহ্য রক্ষায় নতুন পথচলাঃ
ডুমুরিয়ার ইতিহাসবিদ ও কবি আলহাজ শেখ আব্দুল জলিল বলেন, ড. বাকার শুধু এক জমিদার বংশের উত্তরাধিকার নন, তিনি মানবসেবার নতুন অধ্যায়ের রূপকার। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, ঐতিহ্য শুধু রক্ষণাবেক্ষণ নয়, তাকে সমাজের কল্যাণে কাজে লাগানোই আসল শ্রদ্ধা। একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. বাকার জানান, আমি ধামালিয়ার মানুষের মুখে হাসি দেখতে চাই। জমিদারির গৌরব নয়, আমি চাই আমার গ্রামের মানুষ শিক্ষিত, সচেতন, স্বাবলম্বী হোক।
ধামালিয়ার জমিদার বাড়ি আজ আর কেবল প্রাচীন মসজিদ আর ধ্বংসপ্রায় ভবনের স্মৃতি নয়। এটা এখন এক উত্তরাধিকারীর হৃদয়ে গাঁথা স্বপ্ন, যার ভিতর দিয়ে নতুন করে ধামালিয়ার মানুষ খুঁজে পাচ্ছে ইতিহাস, পরিচয় আর আগামীর ঠিকানা।