ফারুক আহমেদ ঃ‘ইয়াস’ থেকে বাংলাদেশ ঝুঁকিমুক্ত হলো। বাংলাদেশে ‘ইয়াস’ তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। বাড়িঘর, স্থাপনার বড় ধরণের কোন ক্ষতি হয়নি। কারণ ইয়াসের প্রধান টাগেট বরাবরই ভারতের উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গের দিকেই ছিল। যদিও খুলনা উপকূলও ঝুঁকির মধ্যে রেখেই দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়া হয়। পরর্বতীতে ইয়াস ভারতে আঘাত হানলেও খুলনা উপকূল তছনছ করে যায়। এতে বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় বিস্তৃর্ণ এলাকা। যেমনি হয়েছিল ২০০৯ সালে আইলায়। তখন দীঘ ৩ বছরের জলাবদ্ধতা খুলনা উপকূলের অর্থনীতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইয়াস কি বাঁধ তছতছ করে আইলা কথাই মনে করিয়ে দিলো?

ইয়াস কি আইলার রূপে আবার ফিরে এসেছে? ইয়াস কি আইলারই প্রতিচ্ছবি? ইয়াস কি আইলার ব্যর্থতাকে আবার মনে করিয়ে দিল? এমনি প্রশ্ন এখন খুলনা উপকূলের লক্ষ মানুষের মধ্যে যারা ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার ক্ষতে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভুগেছে।
২০০৯ সালের ২৫ মে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় আইলা খুলনা উপকূলে পৌছালে বাতাসের গতি অনেকটাই কমে যায়। তখন অনেকেই স্বস্তির নিঃশ^াস ছাড়ে। কিন্তু সবিৎ ফিরে তখন যখন দেখা যায় ভরা কাটালের প্রভাবের সাথে বাতাসের তীব্রতায় উপকূলীয় বাঁধ মুহূতেই ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়।
উপকূলে ৬০ এর দশকে নির্মিত এ বাঁধ খুলনার কয়রা, দাকোপ, সাতক্ষীরা শ্যামনগর এবং আশাশুনীর অনেক জায়গায় মাটির সাথে মিশে যায়। অনেক জায়গায় নদী এবং লোকালয় এক হয়ে যায়। মোংলা, শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জসহ উপকূলীয় উপজেলাসমূহে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এমনি পানিবন্দি অবস্থা আইলা পরবতী ২ থেকে ৩ বছর পর্যস্ত চলেছে। মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি দুঃখ-দুর্দশা এখনো উপকূলের মানুষের কাছে জ¦লজ¦ল করছে।
আইলা পরর্বতী সময়ে উপকূলের বাঁধ নির্মাণ এবং সংস্কারে অনেক আন্দোলন- সংগ্রাম হয়েছে। বাধ নির্মাণের তীব্রতর দাবিতে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, উদ্ধুদ্ধকরণ সভা, গণশুনানী ইত্যাদি হয়েছে। একটি পর্যায়ে যুৎসহ বাঁধ নির্মাণে কিছু পরিকল্পনা নেয়া হয়। তার মধ্যে কিছু বাস্তবায়ন হয়। কিছু ঝুলে থাকে। কিছু ফাইলে থাকে। কিছু পরিকল্পনা পোকায় খেয়ে ফেলে। আবার কিছু প্রকল্পের কথা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা ভুলেই যান। এই ভুলে যাওয়া, অবহেলা করা এবং দীর্ঘসূত্রিতার জালে ‘আইলা’ নামক বিধ্বংসী আপদে বিধ্বস্ত বাধ পুননির্মাণ বা সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সংস্কারের কথাটিও ভুলে যান পানি উন্নয়নে বোর্ডের কতাব্যক্তিরা।

এমনিভাবে আইলা উপাখ্যানভুলে যাওয়ার ফাঁকে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘বিজলী’, ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ান’ু, ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’, ২০১৯ সালে ‘বুলবুল’ এবং ‘ফনি’ উপকূলে মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। এ ঘূর্ণিঝড়গুলি যখন উপকূলে আছরে পড়ে তখন ছিল উপকূলের নদনদীতে ভাটির সময়। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়গুলি ‘ল্যান্ডফলের’ সময় পানির উচ্চতা তেমন বৃদ্ধি পায়নি এবং ঘূর্ণিঝড়ের আকারের কারণে বাতাসের বেগও অপেক্ষাকৃতি কম ছিল। এ কারণে বাঁধ ভেঙ্গে জলোচ্ছ্বাসজনিত ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম হয়েছিল বলে আইলার নিষ্ঠুর হিং¯্রতা, নির্মমতার কথা বাধ নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসহ নীতিনির্ধারকের সকলেই ভুলে যান। সংশ্লিষ্ট সকলেই তাদের স্বভাবসুলভ ‘ভুলে যাওয়া’ এবং ‘তুলে রাখার’ নীতিতে দিনানিপাত করতে থাকেন।
মূলত, আইলার ‘শিক্ষা’ ভুলে গিয়ে উপকূলের মানুষের জানমালের বিষয়টি অনেটাই উপেক্ষা করার কারণে খুলনা উপকূলের দাকোপ, কয়রা, আশাশুনি, শ্যামনগর, শরণখোলা, মোংলাসহ উপকূলীয় উপজেলাসমূহের মানুষ আবারও আরেক আইলার মুখোমুখি হলো যেটাকে সকলেই ওমানের দেয়া নাম- ‘ইয়াস’ হিসেবে দেখছে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস খুবই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল। অল্পের জন্য বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছে। এটি যদি আর ১০০ কিলোমিটার পূবদিক দিয়ে ল্যান্ডফল হতো তাহলে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা এবং খুলনা উপকূল সরাসরি ইয়াসের বলয়ের মধ্যে চলে আসত। আর তাই যদি হতো তাহলো ভরা পূর্ণিমা, চন্দ্রগ্রহণ এবং প্রায় দেড়’শ কিলোমিটারের বেশী বাতাসের তীব্রতায় একাধারে জলোচ্ছ্বাস অন্যদিকে প্রচন্ড ঝড়োবাতাস- এ দুয়ের পরস্পর বিরোধী আস্ফালনে খুলনা উপকূল লন্ডভন্ড হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সেটি হয়নি। তবে যেটি হয়েছে- সেটি কি আইলারই আরেক রূপ, আরেক প্রতিচ্ছ্ববি, আরেক ব্লুপ্রিন্ট- এমনি শংকা এখন উপকূলজুড়ে। কারণ দাকোপ, কয়রা, শ্যামনগর, আশাশুনিতে মারাত্মকভাবে বাঁধ ভেঙ্গেছে। এছাড়াও অন্যান্য উপজেলায়ও প্রায় অভিন্ন চিত্র। ইয়াসের প্রভাবে গতকালও বাঁধ ভেঙ্গেছে। ভাঙ্গা জায়গা বিস্তৃত হয়েছে, গভীর হয়েছে। বাঁধের এ ক্ষত যদি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মেরামত করা না যায় তাহলে দরজার অপেক্ষমান বর্ষা মৌসুম চলে আসবে। বৃষ্টি চলে আসলে বাঁধ মেরামত আরও দীঘস্থায়ী হবে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের আরেকটি ছুঁতোও তৈরী হবে। প্রকল্প প্রস্তাব যতনে তুলে রাখার ছিঁকেও তৈরী হবে।
এতে যথারীতি উপকূলের গরীর মানুষের পানিবন্দীত্ব মেয়াদ বেড়ে যাবে। ফসলের, মাছের এবং চিংিড়র ক্ষতি বাড়তে থাকবে। জীবিকার উৎস ধ্বংস হবে। মোট কথা ‘ইয়াস’ পরবতী পানি দুর্যোগে গরীর মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা-দুর্গতি বাড়তেই থাকবে। এখন প্রশ্ন মানুষের এই দুর্ভোগ-দুর্দশা-দুর্গতির দায় কে নিবে?
উল্লেখ্য, উপকূলজুড়েই নড়বড়ে বাঁধের কারণে উপকূলের লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্যোগ ঝুঁকি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এছাড়াও আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বাঁধের অস্তিত্ব নিয়েও শংকার অন্ত নেই। সার্বিকঅর্থে আইলার ১০ বছরেও যে বাঁধ উপাখ্যান শেষ হলো না তা’ বলাই বাহুল্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জোয়ারের উচ্চতা এবং তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় বাঁধের নাজুক পরিস্থিতির বিষয়টি এখন বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে সার্বিক বিবেচনায় এ কথা এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও ভোলাসহ উপকূলীয় জেলাসমূহের প্রায় ৩৫শ’ কিলোমিটার বাঁধের আওতায় বসবাসকারী আড়াই দুই কোটি উপকূলীবাসীর জীবন-জীবিকা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। উপকূলজুড়ে নির্মিত এই দীর্ঘ বাঁধের যথাপুযুক্ত এবং কার্যকরী সংস্কারের অভাবজনিত কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ যে কত ভয়াবহ হতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ১০ বছর আগের ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’এবং গত পরশুর ঘুণিঝড় ইয়াস।