/ চুইঝাল চাষেই বদলে দিল নবদ্বীপের জীবন

চুইঝাল চাষেই বদলে দিল নবদ্বীপের জীবন

এ সপ্তাহের বিশেষ প্রতিবেদন

এম. এ. হাওলাদার: ‘তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়, গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়।’ পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের সেই কবিতার মতোই খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বরাতিয়া গ্রামের কৃষক নবদ্বীপ মল্লিকের বাড়ি এখন এক সবুজ স্বপ্নলোক। তবে এখানে কেবল সৌন্দর্য নয়, লতায় পাতায় লুকিয়ে আছে সোনালী ভবিষ্যৎ। যে ভবিষ্যতের নাম-চুইঝাল।

স্বপ্নযাত্রা যেভাবে: ২০১৫ সালে উপজেলা কৃষি অফিসের আয়োজিত এক প্রশিক্ষণে অংশ নেন নবদ্বীপ মল্লিক। সেখানে চুইঝাল চাষ সম্পর্কে শোনেন তিনি। কৌতূহল থেকে হাতে নেন কৃষি অফিসের দেওয়া কয়েকটি চারা। পরীক্ষামূলকভাবে লাগানো চারাগুলো আশাতীত সাফল্য এনে দেয়। ধীরে ধীরে তিনি নিজেই কাটিং থেকে চারা উৎপাদন শুরু করেন। প্রথমদিকে কৃষি অফিস তাঁর কাছ থেকে চারা সংগ্রহ করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করত। সেই ক্ষুদ্র সূচনাই নবদ্বীপের জীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

এক বিঘায় কোটি টাকার সম্ভাবনা: মাত্র এক বিঘা জমিতে গড়ে ওঠা তাঁর চারা উৎপাদন কেন্দ্র আজ কোটি টাকার সমমূল্যের চারা বিক্রির কেন্দ্রবিন্দু। গত দশ বছরে তিনি বিক্রি করেছেন দেড় কোটি টাকার বেশি চারা। বর্তমানে তাঁর ‘মেসার্স নবদ্বীপ নার্সারি’ থেকে মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার চারা বিক্রি হয়। প্রতিটি চারা বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। শুধু দেশেই নয়, সীমান্ত পেরিয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে তাঁর উৎপাদিত চারা।

কৃষিতে পূর্ণ আত্মনির্ভরতা: নবদ্বীপ শুধু চুইঝাল চাষেই থেমে থাকেননি। খামারে রয়েছে আধুনিক আল্ট্রা হাইডেন সিটি সিস্টেমের আমবাগান, ড্রাগন ফলের বাগান, মাছভরা পুকুর, মুরগির খামার- সব মিলিয়ে এক বহুমুখী কৃষি খামার। ফলে মাছ, দুধ, ডিম বা সবজি কেনার প্রয়োজন হয় না তাঁর পরিবারের। পাশাপাশি খামারে কাজ করছেন সাতজন কর্মচারী, যা কয়েকটি পরিবারের জীবিকার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্মান ও স্বীকৃতি: পরিশ্রমের স্বীকৃতি হাতছাড়া হয়নি। ২০১৭ সালে বিষমুক্ত সবজি চাষ করে জাতীয় পর্যায়ের কৃষি পুরস্কার অর্জন করেন নবদ্বীপ। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. নজরুল ইসলামের প্রেরণা আর পরামর্শই তাঁকে সামনে এগিয়ে যেতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

চুইঝালের ভেষজ গুণ: খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার মানুষের ঐতিহ্যের অংশ এই মসলা। শুধু রান্নার স্বাদ বাড়ানো নয়, এর রয়েছে অসংখ্য ভেষজ গুণও। গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, ক্ষুধা বাড়ায়, হজমে সহায়তা করে, পাকস্থলীর প্রদাহ সারায়, কাশি, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট কমায়, শরীরের ব্যথা ও মানসিক অস্থিরতা দূর করে, চুইঝালের কান্ড, শিকড়, পাতা, এমনকি ফুল ও ফলও ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ।

খুলনার ব্র্যান্ড-চুইঝালের মাংস: এক সময় চুকনগরের আব্বাস হোটেল ছিল চুইঝালের মাংসের জন্য বিখ্যাত। এখন খুলনার জিরো পয়েন্টসহ নানা স্থানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রেস্তোরাঁ। প্রতিদিন হাজারো মানুষ সেখানে ভিড় জমায়। ঢাকাসহ দূর-দূরান্তের মানুষও শুধুমাত্র এই বিশেষ স্বাদের জন্য ছুটে আসেন খুলনায়।

ইতালি প্রবাসী মো. আশরাফুল বলেন, “এই প্রথম চুইঝালের মাংস খেলাম। অসাধারণ স্বাদ!”। হোটেল কর্মী এনামুল জানালেন, প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক হাজার মানুষ আসেন শুধুই চুইঝালের স্বাদ নিতে।

নবদ্বীপের সাফল্যের গল্প: নবদ্বীপ মল্লিক প্রমাণ করেছেন, কৃষি শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়- সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিলে কৃষি জীবন বদলে দেওয়ার শক্তিশালী হাতিয়ার। চুইঝালের লতার ভেতরে তিনি যেমন নিজের পরিবারের স্বপ্ন খুঁজে পেয়েছেন, তেমনি গড়ে তুলেছেন অন্যদের জন্য কর্মসংস্থান।

আজ তাঁর নাম শুধু একজন সফল কৃষক হিসেবেই নয়, বরং অনুকরণীয় উদ্যোক্তা হিসেবেও উচ্চারিত হয়। গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার বাস্তব দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন তিনি।

কৃষি বিভাগের ভাবনা: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “নবদ্বীপের চেষ্টাই তাকে আজ সফল করেছে। তাঁর সাফল্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে আনন্দিত। কারণ আমি যখন ডুমুরিয়ার কৃষি অফিসার ছিলাম তখনই নবদ্বীপের চুই চাষের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আসলে শুধু নবদ্বীপ নয়, আমাদের সমাজে আরও অনেক নবদ্বীপ আছেন। তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সমাজ বদলের এক অদম্য হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।”