ফারুক আহমেদ।। চৈত্র মাসের শেষ দিনটি যেমন মাসের শেষ দিন তেমনি বছরেরও শেষ দিন। সাধারণভাবে বাংলা মাসের শেষকে বলা হয় সংক্রান্তি। একঅর্থে সংক্রান্তির ধারণাটি এমন যে, কালের আর্বতে অসীমের মধ্যে সাঁতরে, সূর্য এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে (মীন রাশিতে প্রবেশ করে) গমন করে। ছুটে চলার সময় দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, অবিরাম চলে সংক্রান্তি সঞ্চারে। অর্থাৎ এক ক্রান্তি থেকে বা প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত বা ক্রান্তিতে যায়।
আজ বাংলা চৈত্র মাসের সর্বশেষ দিন। এ দিনটিকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। এক সময় বাংলার প্রতিটি ঋতুরই সংক্রান্তির দিনটি উৎসবের আমেজে পালন করতো বাঙালি। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সে উৎসব। সংক্রান্তি শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো গ্রহাদির এক গ্রহ বা রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন, সঞ্চার, ব্যপ্তি। যেমন চৈত্র সংক্রান্তি হলো চৈত্র মাসের শেষ দিন। কথিত আছে, বাংলা পঞ্জিকার চৈত্র মাসের নামকরা হয়েছিল ‘তিক্রা’ নক্ষত্র হতে। পুরানে আছে, সাতাশটি নক্ষত্রের নামে দক্ষ রাজ সুন্দরী কন্যাদের নাম রেখেছিলেন। তাদের দুই কন্যার নাম যথাক্রমে চিত্রা ও বিশাখা। এক মাসের ব্যবধানে জন্ম বলে এই দুই কন্যার নাম থেকে জন্ম নিল বাংলা দুই মাস: যথাক্রমে চৈত্র ও বৈশাখ। পৌরাণিক সূত্র মতে, দক্ষ রাজার সাত মেয়ের বিয়ে হয় চন্দ্রদেবের সংগে। সেই সাতজন মেয়ের একজন চিত্রা। তার নাম অনুসারে চিত্রা নক্ষত্র এবং চিত্রা নক্ষত্রের নাম হতে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে বাঙালীরা চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে পালন করেন। এখনো এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের মত পালন করেন চৈত্র সংক্রান্তি দিনটি।
চৈত্র সংক্রান্তি প্রধানত সনাতনী সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও কালের পরিক্রমায় বাংলার ভূখন্ডে এটি আর সনাতনি আচার নয় বরং এটি মিশে গেছে বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক বাঙালীর সংস্কৃতির মাঝে। তাই চৈত্র সংক্রান্তি আজ ‘বাঙালী উৎসবে’ পরিণত হয়েছে। চৈত্রের শেষ আর বৈশাখের শুরু। বাঙালীর সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান পালিত হয় এ দুই দিনে। কখনো ধর্মীয় বিশ্বাস, কখনো আবহমান বাংলার ঐতিহ্য আর লোক লোকায়িত উৎসবের ধ্বনি পাওয়া যায় এই দিনটি ঘিরে।
সনাতন ধর্ম পালনকারীগণ চৈত্র সংক্রান্তিতে নানা লোকাচার পালন করেন। মুসলমানরা মেলায় যোগ দেন উৎসবের আমেজে। মেঘ বৃষ্টি জল কামনায় কৃষিজীবীরা আচার-ক্রিয়া পালন করেন। ব্যবসায়ীরা হাল খাতার আয়োজন করেন। সমাজে একটি অংশ শিবের গাজন উপভোগ করে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতিসত্তাগুলি বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজুর মত উৎসবগুলি পালনের প্রস্তুতি দিন হিসেবে চৈত্র সংক্রান্তিকেই বেছে নেয়। তারা পালন করেন বর্ষ বিদায় এবং বর্ষবরণ অনুষ্ঠান-বৈসাবী। তাই, চৈত্র সংক্রান্ত্রি একান্ত কৃষিজীবীর উৎসব হলেও আজ সমাজ কাঠামো পরিবর্তের কারণে ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে পালন করে থাকে যা অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।