মালামাল পাচারের সময় ধৃত

এইচ এম আলাউদ্দিন ঃ কথায় আছে ‘চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন’। এ প্রবাদ বাক্যটি শেষ পর্যন্ত কার্যকর হলো খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্ষেত্রে। এ হাসপাতালের পুরাতন অনেক মালামাল স্তুপ করে রাখা হয়েছিল হাসপাতাল অভ্যন্তরের একটি পরিত্যক্ত ভবনে। যে ভবনের জানালার রডও সম্প্রতি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ভবনটিও ভেঙ্গে ফেলার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গণপূর্ত অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছেন। আর এ সুযোগে ওই ভবনের মধ্যে থাকা মালামালগুলো রাতারাতি সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ গত বুধবার একটি মিনি ট্রাকযোগে মালামাল পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। কারা এর সাথে জড়িত সেটিও চিহ্নিত করা যায়নি। বরং আটক করা ট্রাকটির নম্বর ও চালকের মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের উপ-পরিচালক বিষয়টিকে ‘সামান্য ঘটনা’ বলে উল্লেখ করলেও এ নিয়ে বিগত তিনদিন ধরে হাসপাতাল এলাকায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা: মো: রবিউল হাসান বলেন, বুধবার তিনি বেলা আড়াইটায় অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার পর বিকেল চারটায় খবর পান হাসপাতালের পেছনের রেডিওলজি বিভাগের পশ্চিম পাশের পরিত্যাক্ত ভবন থেকে কিছু মালামাল কে বা কারা ট্রাকযোগে নিয়ে যাচ্ছে। এটি তিনি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: মো: কাইয়ুম তালুকদারকে জানালে তিনি তাৎক্ষনিক গিয়ে হাতে-নাতে ট্রাকটি আটক করে মালামালগুলো নামিয়ে রাখেন। এরপর ট্রাকের নম্বর ও চালকের কাছ থেকে মুচলেকা রেখে ট্রাকটি ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনার সাথে হাসপাতালের কেউ জড়িত আছে কি না সেটি খতিয়ে দেখা হবে উল্লেখ করে পরিচালক বলেন, আজ তিনি কর্মস্থলে ফিরে বিষয়টি দেখবেন। তবে সবকিছুই উপ-পরিচালক ভালো বলতে পারবেন বলেও তিনি জানান।
অবশ্য এরপর উপ-পরিচালক ডা: মো: কাইয়ুম তালুকদারকে ফোন দেয়া হলে তিনি ঘটনা শুনে প্রথমেই পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘তাতে কি হয়েছে ?’ ঘটনা সঠিক কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওরকম কিছু না, সামান্য একটা ঘটনা আছে, বড় স্যার(পরিচালক) আসুক, তারপর দেখা যাবে’। এসময় ট্রাকটি কোথায় জানতে চাইলে তিনি আবারো পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘ট্রাক কি আমি ধরে রেখেছি নাকি ? ট্রাক ট্রাকের জায়গায়’। উপ-পরিচালকের এমন মন্তব্যেও সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
ঘটনাস্থল যেখানে তার পাশেই রয়েছে হাসপাতালের লাশঘর। ওই লাশঘরের দায়িত্বে রয়েছেন একজন আউটসোর্সিং কর্মচারী। জাহাঙ্গীর নামের ওই কর্মচারীর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে কাগজ দেয়ার কথা ছিল। কাগজ পেতে দেরি হয় বলে ট্রাকে উঠানো মালামাল নামিয়ে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের হিসাব বিভাগের এক কর্মীর নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনি কাগজ রেডি করে দেয়ার কথা। কিন্তু কাগজ রেডি না হওয়ায় মালামাল নামিয়ে রাখা হয়।
হাসপাতালের ক্যাশিয়ার মো: আব্দুল আলিম গতকাল বলেন, ওই গোডাউনে কিছু পুরাতন কাগজপত্র ছিল। যেগুলো লাশঘরের দায়িত্বে থাকা আউটসোর্সিং কর্মচারী নেয়ার জন্য বললে তিনি এজন্য অফিসিয়ালভাবে সেগুলো নেয়া এবং এজন্য যে অর্থ জমা দেয়া হবে তা হিসাব দপ্তরে(এজি অফিস) জমা দেয়ার কি বিধি রয়েছে সেটি জানার চেষ্টা করেন। হাসপাতালের প্রধান সহকারীর সহায়তায় এ বিষয়ে একটি কাগজ প্রস্তুত করার কথা ছিল। কিন্তু সেই কাগজ প্রস্তুতের আগেই মালামালগুলো ট্রাকে উঠানো হচ্ছিল। যা পরে নামিয়ে রাখা হয়। তিনি জানান, এ হাসপাতাল থেকে আগে যেসব পুরাতন কাগজপত্র বা মালামাল বিক্রি হয়েছে তার কোন টাকাই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়নি। বরং তিনিই ওই মালামালের টাকা এজিতে জমা দেয়ার জন্য অনেক পথ খুঁজে বেড়িয়েছেন।
হাসপাতালের প্রধান সহকারী মো: মাহবুব হোসেন বলেন, তিনিও পুরাতন কাগজপত্র সরিয়ে নেয়ার কথা জানার পর হাসপাতালে ডিউটিরত আনসার সদস্যদের এবং উপ-পরিচালককে বলেন। উপ-পরিচালক সেখানে গিয়ে দেখেন যারা মালামাল নিচ্ছিল তারা পালিয়ে যায়। তাৎক্ষনিক মালামাল পাচার ঠেকানো হয় বলেও তিনি জানান। তবে তিনি বলেন, ওই ভবনে তেমন কোন দামী মালামাল নেই, শুধুমাত্র কিছু পুরাতন কাগজ রয়েছে। সেখানে যেসব রড ও অন্যান্য মালামাল ছিল সেগুলো সাবেক পরিচালক এটিএম এম মোর্শেদ এর আমলে টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অবশ্য হাসপাতালের অপর একটি সূত্র জানায়, চতুর্থ তলার শিশু ওয়ার্ড স্থাপনের সময় সেখানের জানালার যত রড ও এনকিউবেটর মেশিনসহ অন্যান্য মালামাল ছিল সেগুলো ওই ভবনে রাখা হয়। কিন্তু সেখানে দিন-রাতের অধিকাংশ সময় অবস্থান করা একজন আউটসোর্সিং কর্মচারী সেগুলো ধীরে ধীরে এভাবে সরিয়ে ফেলেন। আর ওই কর্মচারীকে সহায়তা দিয়ে আসছেন হাসপাতালের কয়েকজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। যে আউটসোর্সিং কর্মচারী কিছুদিন আগে দুদকের অভিযানকালে লাশ আটকে রেখে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়াসহ চড়ামূল্যে কফিন বিক্রির অভিযোগে ধৃত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবারও তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তাকে অজ্ঞাত কারণে সেখানে বহাল রাখেন। বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করা হলে আসল রহস্য বের হয়ে আসতে পারে বলেও একাধিক সূত্রের দাবি।