খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প : চুক্তি বাতিলের পর কাজ বন্ধ রাখতে মামলা করেছে মাহাবুব ব্রাদার্স
ভাঙাচোরা সড়কে সীমাহীন ভোগান্তি নগরবাসীর
এ এইচ হিমালয়: প্রায় একযুগ ধরে ভাঙাচোরা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের জটিলতা কাটছেই না। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করা, মাঝপথে কাজ ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ তৈরির কারণে গত ৭ আগস্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্সের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। সড়কের বাকি কাজ দ্রুত শেষ করতে গত ২৪ আগস্ট নতুন করে দরপত্র আহ্বান করেছে কেডিএ।
কিন্তু এবার সেই কাজে বাঁধা সৃষ্টি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্স। সম্প্রতি নতুন দরপত্রের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে আদালতে মামলা এবং ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে আরবিট্রেটর নিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে নিরাপত্তা জামানত বাজেয়াপ্ত করার আদেশের বিরুদ্ধে আদালতের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করেছিল তারা। আদালত ওই টাকা কেডিএর অনুকূলে হস্তান্তর না করতে ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে মাহাবুব ব্রাদার্সের তৎপরতায় সড়ক সংস্কার কাজ আবারও দীর্ঘসূত্রিতার কবলে পড়েছে।
এদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের আগে থেকেই সড়কের কাজ বন্ধ রয়েছে। গত এক মাস কোনো কাজ হয়নি। এতে বৃষ্টির পানি জমে সড়কের অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে। প্রায় সড়কে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ যানবাহনের চাকা আটকে যাচ্ছে। জনভোগান্তির প্রতিবাদ এবং দ্রুত কাজ শুরুর দাবিতে গত ২ সেপ্টেম্বর সড়কটিতে ধানের চারা লাগিয়ে প্রতিবাদ করে বিভিন্ন সংগঠন।
স্থানীয়রা জানান, ৩ দশমিক ৭৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন থেকেই সড়কটি ভাঙা চোরা। মেরামতের কিছুদিন পরই সড়কে গর্ত তৈরি হতো। ২০১৩ সালের ৭ মে সড়কটি ৪ লেনে প্রশস্ত করে পুনঃনির্মাণের জন্য একনেকে প্রকল্প অনুমোদন করায় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ছিল ৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় প্রকল্প সংশোধন করা হয়। ব্যয় বেড়ে দাড়ায় ২৫৯ কোটি টাকা।
সূত্রটি জানায়, ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আতাউর রহমান লিমিটেড অ্যান্ড মাহাবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড (জয়েন্ট ভেঞ্চার) কে কার্যাদেশ দেয় কেডিএ। ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তাদের ৩ দশমিক ৭৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কটি ৪ লেনে প্রশস্ত করে পুনঃনির্মাণ, দুই পাশে ড্রেন ও ফুটপাত, সড়কের মাঝে দশমিক ৯২ মিটার ডিভাইডার নির্মাণ, লবণচরায় ৬৬ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ এবং মতিয়াখালীতে স্লুইসগেট ও কালভার্ট নির্মাণের জন্য কথা ছিল।
ওই বছর ২০ জানুয়ারি কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের একবছর বেশি অতিবাহিত হলেও অর্ধেক কাজ শেষ হয়নি। গত সাড়ে ৩ বছরে বিগত সরকারের পূর্ত মন্ত্রী, সচিব, অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা খুলনায় এসে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য ঠিকাদারকে নির্দেশ দিয়েছেন। কালোতালিকায় অন্তর্ভুক্তিরও হুশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও কাজে গতি আনেনি ঠিকাদার।
প্রকল্প কার্যালয় থেকে জানা গেছে, গত সাড়ে ৩ বছরে ঠিকাদার ৭০ কোটি টাকা তুলেছেন। কিন্তু অনেক কাজ শেষ হয়নি। বর্তমানে সড়কের বেজ টাইপ-২ (বর্তমান সড়কের ওপর পাথরের স্তর), বেজ টাইপ-১, ৪ ইঞ্চি বিটুমিনের কার্পেটিং (পিচের স্তর), তারওপর সিলকোর্ট (বিটুমিনের আরেকটি স্তর) দেওয়া বাকি রয়েছে।
৬৬ মিটার দৈর্ঘ্যরে লবণচরা সেতুর ১০টি গার্ডারের মধ্যে মাত্র একটির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৯টি বাকি রয়েছে। মতিয়াখালীতে দুই স্তরের স্লুইচগেটের মধ্যে এক স্তর শেষ হয়েছে। অন্য স্তর স্থাপন না করায় জোয়ারের সময় ওই গেট দিয়ে শহরের ভেতরে পানি প্রবেশ করছে।
খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক মো. আরমান হোসেন জানান, সড়কের ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চুক্তি বাতিল করে জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে। দ্রুত কাজ শুরুর জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। ঠিকাদার এর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। করণীয় নির্ধারণে কেডিএর আইনজীবীদের মতামত চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যতোটুকু কাজ করেছেন ততোটুকুর বিল দেওয়া হয়েছে। বাড়তি বিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্সের বক্তব্য জানতে প্রকল্প কার্যালয়ে গিয়ে সেটি তালাবদ্ধ দেখা গেছে। মাহাবুবুর রহমানের মোবাইল নম্বরে একাধিক ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
কেডিএর প্রকৌশলীরা জানান, ঠিকাদার স্বেচ্ছায় যোগাযোগ না করলে তারাও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, সড়কের পাশে ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ২৭টি চাল কল, ২৫০টি কাঠের গোলা এবং বান্দাবাজারে ৪৫০টির বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নাজুক সড়কের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা। সড়ক দিয়ে ৩০ ও ৩১নং ওয়ার্ডের লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে। একযুগ ধরে সবাই কষ্ট পাচ্ছে। এর পরিত্রাণ জরুরী।