আসাদুজ্জামান বিকু: বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে ৩১ প্রজাতীর বন্যপ্রাণী ও প্রায় ২৬০ প্রজাতীর পাখি। একই সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে মিঠা পানির কুমীর। আবার বন উজাড়ে কমছে বন্যপ্রাণী ও পাখির খাদ্যের জোগানও। এমন নানা সংকটে উভচর, সরীসৃপ, পাখি ওস্তন্য পায়ী মিলে গত শত বর্ষে দেশ থেকে প্রায় ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী চিরতরে নিঃবংশ হয়ে গেছে। আবার ঝুঁকিতে পড়েছে আরো ৬৯ প্রজাতির প্রাণী। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য ও বাসস্থান সংকট, বন উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ নানাবিধ কারণে আমাদের দেশ থেকে বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০০০সালের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত বন্যপ্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা ছিল ১৩। আর ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্তর তথ্য দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এ ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে আঞ্চলিক ভাবে বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ১৬ প্রজাতির প্রাণী।
এদিকে খুলনা বিভাগে বন্যপ্রাণী ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি হারিয়ে যেতে বসেছে। এগুলো রক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা বরাবরে বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, গবেষক ও লেখক আশিকুর রহমান সমী একটি আবেদন করেছেন। এই আবেদনের বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে উল্লেখিত এলাকায় জীব বৈচিত্র্য রক্ষা পাবে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আশিকুর রহমান সমী বলেন, জলাভ‚মির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হলো বাঁওড়। হাওরের সঙ্গে সবাই পরিচিত হলেও, আমরা বাঁওড় সম্পর্কে তেমন অবগত নই। এমনকি বাঁওড়ের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যও নেই। দেশের গঙ্গা-নি¤œবর্তী অঞ্চলে ছোট-বড় মিলে ৮৭টি বাঁওড় রয়েছে। আমাদের দেশের মোট আয়তনের ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর এলাকা এই বাঁওড়ের অন্তর্ভুক্ত। বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণ বাঁওড় শুষ্ক মৌসুমে অনেকটা শুকিয়ে যায়। বর্ষাকালে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলাসহ বিভিন্ন ভাসমান উদ্ভিদে পরিপূর্ণ থাকে বাঁওড়।
ভাসমান পাতার ফাঁকে জলময়ূর, কলপিপি, ডাহুক, কোড়ার ছোটাছুটি এক অদ্ভুত মনোরম দৃশ্য। শীতে পানি কমে গেলে, জলজ উদ্ভিদগুলোর নিচে তৈরি হয় পাখিদের খাদ্যের এক অপূর্ব ভান্ডার। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে পাখি। বাঁওড়ের পাখিদের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ও পরিযায়ী বুনোহাঁস। সরালি, বালিহাঁসের সংখ্যা তুলনা মূলক বেশি। তবে শীতে যখন পাখি কমে যায়, তখন সরালি আর বালি হাঁস দুটোই বাড়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে শত শত সরালি উড়ে বেড়ায় এখানে। তখন আসে পরিযায়ী বুনোহাঁস। যেমন মৌলবি হাঁস, পিয়াংহাঁস, তিলিহাঁস, ভুতিহাঁসসহ আরও অনেকে। ডুবুরি বাঁওড়ের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ পাখি। ঝাঁকে ঝাঁকে ডুবুরি ভেসে বেড়ায় এখানে আর শীতে সংখ্যায় বাড়ে অনেক বেশি।
এ ছাড়া বড় পানকৌড়ি উল্লেখযোগ্য এক পাখি। ডাহুক, ঝিল্লি, গুড়গুড়ি,পাতিপান মুরগি, পাতি কুট, চ্যাগা, কোড়া কালেমসহ বিভিন্ন পাখির জলজউদ্ভিদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ। তিনি জানান, বাঁওড় পারের গণমানুষের সঙ্গে আলাপ করলে উঠে আসে আগের মতো আর দেখা যায় না বৈচিত্র্যময় পাখি। আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে, বিশেষ করে যুক্ত করতে হবে তরুণদের। তারাই বেশি ভ‚মিকা রাখবে পাখিদের সংরক্ষণে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে মানবসৃষ্ট কারণ সবচেয়ে বেশি ভ‚মিকা রাখছে। যেমন বন্যপ্রাণীর বাসস্থান নষ্টকরা হচ্ছে । জনসংখ্যার ঘনত্ব, নগরায়ন, জলাশয় ভরাটের কারণে এসব প্রাণী হুমকিরমুখে পড়ছে। এছাড়া হাওরে দেখা যায় অতিরিক্ত চায়না জালের ব্যবহার। এতে পাখিকমে যাচ্ছে। এসব কারণে আবার প্রজনন স্থান নষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন ৫৩টি এলাকাকে বন্যপ্রাণী প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিবেচনায় রয়েছে পাঁচটি সামুদ্রিক প্রটেক্টেড এরিয়া। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন জনিত নানা সমস্যার কথা বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এগুলো ধরে রাখা গেলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্ভব হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বন্যপ্রাণী গবেষক সমী আরো বলেন, শহর এলাকায় আবাস স্থল হারিয়ে জীব বৈচিত্র্যে কতটা ঝুঁকিতে তা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু শহরের যে পার্কগুলো এক চিলতে সবুজ পরিবেশ ছিলো তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। বিশেষ করে চিত্ত বিনোদনের পার্কগুলো ব্যবহারের কারণে সেগুলো ক্রমেই সৌন্দর্য বর্ধনের আওতায় আসছে। আর এই জায়গাগুলোর দেশি লতাগুল্ম হারিয়ে স্থানগুলো ভরে উঠছে সৌন্দর্য বর্ধক গাছে। ফলে শহর গুলো একেবারে হারিয়ে ফেলছে বুনো পাখিদের কলকাকলি। তিনি আরো বলেন, এ দেশের পরিচিত পাখির ঝুঁকি, পাখি শিকার,পাচার, চোরাচালান, নগরায়নের বাইরে আরও অনেক কারণ রয়েছে। যার ফলে বাংলার পাখিরা আজ বিপন্ন। বাংলাদেশে আবাস স্থলজনিত সমস্যার কারণে ক্রমেই হুমকির মুখে পাখিরা।