পূর্বাঞ্চলকে দেয়া
একান্ত সাক্ষাৎকার

স্টাফ রিপোর্টার ঃ ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বরিশালে জন্মগ্রহণকারী বর্তমানে খুলনার বাসিন্দা জেমস্ তরুণ সরকার কাজলের চোখে আজও ভাসছে ভাষা আন্দোলনের সেই দৃশ্য। এখনও ঢাকায় গেলে সদরঘাটের বাহাদুরশাহ্ পার্ক এবং জগন্নাথ কলেজের বিপরীতের মিশন দোতলা হোস্টেলের উপরে উঠে তিনি তাকিয়ে থাকেন রক্ত রঞ্জিত সেই রাজপথে। ভাষা আন্দোলনে রাজপথে নেমে পুলিশের গুলিতে নিহত একজনের লাশ কাঁধে অন্য একজনের হেটে যাওয়ার দৃশ্য আজও যেন তার চোখের সামনে ভাসছে। ভাষা আন্দোলনের এমন অনেক স্মৃতির কথা জানালেন জেমস্ তরুণ সরকার কাজল। দৈনিক পূর্বাঞ্চলকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, ভাষার জন্য জীবন দেয়া সালাম, জব্বার, শফিক, রফিক, বরকতদের কথা আজ বিশ^বাসী স্মরণ করছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশে^ আজ পালিত হচ্ছে এ দিবসটি। এর অনুভুতি যে কেমন হতে পারে তা বলে প্রকাশ করা যাবে না। সরাসরি ভাষা আন্দোলনে যুক্ত না থাকলেও সেই আন্দোলনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন তিনি। এটিও তার জীবনে একটি বড় পাওয়া বলেও জানালেন। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে তিনি এবং তার এক সহপাঠী বরিশাল থেকে ঝালকাঠি পর্যন্ত বাইসাইকেল চালিয়ে গিয়ে স্কুল বন্ধ করে কালোব্যাজ ধারণ করে ভাষা দিবস পালনের স্মৃতিও তার মনে পড়ে। ওই সময় ঝালকাঠিতে ভাষা দিবসের আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের হাতে বন্দি ও পরে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাওয়ার স্মৃতিও জানালেন তিনি।
কেমন দেখেছিলেন ৫২’র ভাষা আন্দোলন এমন প্রশ্নের জবাবে জেমস্ তরুণ সরকার কাজল বললেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার সদরঘাট এলাকার একপাশে বাহাদুরশাহ্ পার্ক ও জগন্নাথ কলেজ এবং বিপরীতে মিশনের দোতলা হোস্টেলে তিনি অবস্থান করছিলেন। সবই কাছাকাছি, মধ্যে শুধু প্রশস্ত রাজপথ। তিনি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। বেলা ১১টা থেকে ১২টার দিকে চিৎকার ও কোলাহল শ্লোগান শুনে দোতলায় উঠে তাকিয়ে দেখেন রনক্ষেত্র। পুলিশ সশস্ত্র আর ছাত্ররা নিরস্ত্র। তবুও মুহুর্মুহু শ্লোগান ও গুলির শব্দ এবং কাঁদানে গ্যাস এর শেল ফাটার শব্দ। তারা দোতলায় বসে সিনেমার মত দেখছেন। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ফায়ার করে শেল ছুড়ছে ছাত্রদের দিকে। কোন কোন ছাত্র মুখে ভিজা রুমাল চেপে ঐ শেল পুলিশের দিকে ফেরত দিচ্ছে। সমস্ত দেশ উত্তাল দুম দুম শব্দে শেল ফাটছে। “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” জয়ধ্বনিতে শত কণ্ঠের শ্লোগান। লাঠি পেটা হচ্ছে তবু শ্লেøাগান চলছে। এর মধ্যে একটা দল আসলো একজনের হাতে এক যুবকের লাশ, শ্লোগান দিতে দিতে পাটুয়াটুলির দিতে চলে গেল।
৫২’র ভাষা আন্দোলনের আর একটি স্মৃতির কথা তুলে ধরে জেমস্ তরুণ সরকার বলেন, ছোট মামা বরিশাল বি,এম কলেজে পড়েন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ফিরোজ খান নুন কলেজে পরিদর্শনে আসলে ছাত্ররা তাকে জুতা দেখায়। গ্রেফতার এড়াতে মামা ঘরে এসে ২/৩ টা জামা নিয়ে তাড়াহুরা করে চলে গেলেন।
ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে প্রথম বারের মতো ভাষা দিবস পালনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৫৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী বরিশাল মিশন স্কুলে তিনি তখন দশম শ্রেণিতে পড়েন। অনেকের মতো তিনিও কালো ব্যাজ লাগিয়েছেন। যদিও কালো ব্যাজের ব্যাপারে শিক্ষকদের নিষেধ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনিসহ সব শিক্ষার্থী কালোব্যাজ ধারণ করেন। তিনি ও তার সহপাঠী কেরামত আলী সাইকেলে করে বরিশাল জিলা স্কুলে গিয়ে দেখেন তারা প্রায় সবাই কালো ব্যাজ পরে শ্লোগান দিচ্ছে। এতে তারা উৎসাহিত হন। নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের বললেন যেন তারা তাদের স্কুল বন্ধ রাখেন এবং রুপাতলী ও ঝালকাঠীতেও বন্ধ রাখা হয়। তারা ফিরে এসে তাদের স্কুলে জানালে সহপাঠীরা মহা উৎসাহে রূপাতলী ও ঝালকাঠী যেতে বললেন। বরিশাল থেকে ১৪ মাইল দূরে ঝালকাঠি। সুড়কির অমসৃন রাস্তা পথে নদী, পোল, বাশের চার, বেশ কয়েকটা। পরদিন ভোরে তিনি ও কেরামত আলী একটা সাইকেলেই ডাবলিং করে রওনা দিলেন। পথে রুপাতলীতে দুই/তিন জন ছাত্রকে বিষয়টা জানিয়ে আড়াই ঘন্টার মধ্যে ঝালকাঠি জিলা স্কুলে পৌঁছে গেলেন। একজন সাইকেল চালান আর একজন সামনের রডের ওপর বসেন। এভাবে বারবার বদল করে রডে ও সিটে বসে সাইকেল চালিয়ে ঝালকাঠি গেলে জিলা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের সাদরে বরণ করে নিল এবং ওদের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল। দেড় ঘন্টার মধ্যেই সমস্ত ঝালকাঠি শহর বন্ধ হয়ে গেল। শ্লোগান ও বক্তৃতায় ভরপুর ঝালকাঠি সংগে কালো ব্যাজ। দুই/আড়াই ঘন্টা পরে হঠাৎ পুলিশের দারোগাসহ ৪/৫ জন পুলিশ এসে তাদের দু’জনকে বন্দী করে থানার হাজতে ঢুকালেন। পিছনে অগনিত ছাত্র-ছাত্রী দল ও শ্লোগান ও করতালি। সে এক দারুন মুহূর্ত। থানায় এসে ওরা চিৎসার করে তাদের ছাড়ার দাবি জানালো। আনুমানিক ২ ঘন্টা পর দারোগা তাদের গালমন্দ করে জিজ্ঞাসা করে ঝালকাঠিতে তাদের কোন আত্মীয় আছে কিনা। মনে পরে গেল তার এক দূর সম্পর্কের মামা স্থানীয় স্টিমার কোম্পানীতে চাকুরী করতেন তার কথা। খবর দেওয়ায় তিনি এসে তাদেরকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন। এরপর ওই সাইকেলে করেই তামরা ফিরে যান বরিশালে ফিরে যান। ফিরতে ফিরতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরদিন তাদের স্কুলে পুলিশ গিয়ে প্রধান শিক্ষক ও তার বাবার বন্ড স্বাক্ষর করে নেয়। সমস্ত দেশে তখন আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতার। রাষ্ট্র ভাষা উর্দু বাতিল হয়ে গেল। এরপর থেকে প্রতি বছর তিনি ২১ শে ফেব্রুয়ারী সকালে খালি পায়ে থাকেন ভাসা শহীদদের সম্মানে।
আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত হওয়া বাংলা ভাষা আজ শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বরং সারাবিশ^ব্যাপী পালিত হচ্ছে দিবসটি এটি আপনার কাছে কেমন লাগছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ যে কি অনুভুতি তা’ বলে প্রকাশ করা যাবে না। স্মৃতির পাতায় শুধুই যেন ৫২’র ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাসছে। লাশ কাঁধে সেই লোকটির কথা আজও মনে পড়ছে তার। কিন্তু এখনও আবিষ্কার করতে পারেননি কার লাশ ছিল সেটি বা কার কাঁধে ছিল সেটিও। তবুও স্মৃতিতে অম্লান সেদিনের নাম না জানা অনেকের কথা।