/ টেকসই কৃষির নতুন সম্ভাবনা

টেকসই কৃষির নতুন সম্ভাবনা

এ সপ্তাহের বিশেষ প্রতিবেদন

এম.মুর্শেদঃ বাংলাদেশের কৃষি দীর্ঘদিন ধরেই রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে ইউরিয়া,টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের ব্যবহার ক্রমেই বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে,প্রতিবছর দেশে গড়ে ৫০-৫৫ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার হয়,যারমধ্যে ইউরিয়ার পরিমাণ প্রায় ২৬-২৭ লাখ টন।

খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকেরা দেখিয়েছেন,ইউরিয়া সার ছাড়া ধান চাষও সম্ভব এবং তা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনকও। বটিয়াঘাটা উপজেলার শুড়িখালী গ্রামের কৃষক মো. শাহাজাহান হোসেন এবার ৭০ শতক জমিতে রাসায়নিক সার ছাড়াই রোপা আমন ধানের চাষ করেছেন। বোরো ধান কাটার পর শাহাজাহান জমিতে ধৈঞ্চার বীজ বপন করেন। প্রায় ৪৫ দিন পর গাছ বেড়ে ওঠার পর তা কেটে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। স্থানীয়ভাবে এই প্রক্রিয়াকে সবুজ সার প্রয়োগ বলা হয়। এছাড়া মোহাম্মদনগরের আবুল বাশার, চক্রাখালীর মোঃ শাজাহানসহ অন্যান্য কৃষকেরাও ধান চাষ করেছেন এ পদ্ধতিতে।


এই পদ্ধতিতে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে, বায়ুমণ্ডলীয় নাইট্রোজেন জমিতে যুক্ত হয়, মাটির অনুজীব সক্রিয় হয়ে ফসলের পুষ্টি গ্রহণ সহজ হয়। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী এক হেক্টর জমিতে ধৈঞ্চা মাটির সঙ্গে মিশালে প্রায় ৬০-৮০ কেজি নাইট্রোজেন পাওয়া যায়। এটি প্রায় ৪ থেকে ৫ বস্তা ইউরিয়া সারের সমান। ফলে ব্যয়সাপেক্ষ রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমে আসে।

শাহাজাহান হোসেন বলেন, কৃষি অফিসের পরামর্শে ধৈঞ্চা ব্যবহার করেছি। ধান সুস্থভাবে বেড়েছে, একটিও রাসায়নিক সার দিতে হয়নি। এতে আমার প্রায় ৬-৭ হাজার টাকা সাশ্রয় হয়েছে। শুধু তাই নয়, জমির মাটিও আগের চেয়ে ঝুরঝুরে ও উর্বর মনে হচ্ছে। এখন আমার জমিতে বছরে চারটি ফসল হয় বোরো ধান, ধৈঞ্চা, আমন ধান ও বিনা চাষে সরিষা। তিনি আরও বলেন, আগে রাসায়নিক সার কিনতে অনেক খরচ হতো, বাজারে দাম বাড়লেই কৃষকের পকেটে চাপ পড়ে। এখন বুঝতে পারছি বিকল্প পথও আছে।

প্রবীণ কৃষক আবুল বাশার জানান, আমার জীবনে প্রথমবার রাসায়নিক সার ছাড়া ধান চাষ দেখলাম। ফলনও ভালো হচ্ছে। আগামী বছর আমার ১০ বিঘা জমিতেও ধৈঞ্চা লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। শাহাজাহানের জমি দেখতে প্রতিদিনই আশপাশের কৃষকরা ভিড় করছেন। অনেকেই নিজের জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ধৈঞ্চা চাষ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জীবানন্দ রায় বলেন,উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে মাটির উর্বরতা কমছে। তাই কৃষকদের আমরা ধৈঞ্চা চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। শুড়িখালীর এই উদ্যোগ অন্যদের জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে এ অঞ্চলে প্রায় ১১০ বিঘা জমিতে কৃষকেরা আগামী মৌসুমে ধৈঞ্চা লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন।

খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে এবছর খুলনা জেলার ১১ টি থানায় ২৮০ হেক্টর জমিতে ধৈঞ্চার আবাদ করা হলেও ১৯৯ হেক্টর জমিতে সবুজ সার হিসেবে ধৈঞ্চার ব্যবহার করে আমন ধানের চাষ হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবুবকর সিদ্দিক বলেন, এ এলাকার জমিতে তরমুজ চাষের পর পতিত জমিতে চাষের জন্য কৃষি অফিসের প্রনোদনার মাধ্যমে ২১০ জন কৃষককে ৫ কেজি করে ধৈঞ্চার বীজ দেয়া হয়েছে । ধৈঞ্চার বীজ রোপনের ৪৫ দিন পর চারা মাটির সাথে মিশিয়ে ধানের চারা রোপন করা হয়। এ পদ্ধতিতে আমন ধানের চাষে কৃষকদের খরচ কমে এবং তারা লাভবান হবে। ইতো মধ্যে আমন ধানের বয়স ৪০ থেকে ৬০ দিন হয়েছে। আমরা আশা করছি কৃষকরা কাঙ্খিত ফলন পাবে।

খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন,ধৈঞ্চা শুধু সবুজ সার নয়,মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও অত্যন্ত কার্যকর। রাসায়নিক সার সীমিত পরিমাণে ব্যবহার করলে জমির ভারসাম্য টিকে থাকে, কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহার করলে জমি শক্ত ও অনুর্বর হয়ে যায়। ধৈঞ্চা সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ইউরিয়া সারের জন্য বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। অথচ ধৈঞ্চা জাতীয় সবুজ সার ব্যবহার করলে একই পরিমাণ নাইট্রোজেন জমিতে পাওয়া সম্ভব। এতে সরকারের ভর্তুকির বোঝা কমবে, কৃষকের খরচও বাঁচবে। আর সবুজ সার শুধু পুষ্টি সরবরাহ করে না, বরং মাটির জৈব উপাদান ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ভারসাম্যও রক্ষা করে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।

পরিবেশবিজ্ঞানী ড. মাহমুদা খাতুন মনে করেন,রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করা মানে কার্বন নির্গমনও কমবে। কারণ ইউরিয়া সারের উৎপাদন ও অতিরিক্ত ব্যবহার উভয়ই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বাড়ায়। ফলে সবুজ সার ব্যবহারে শুধু কৃষিই টেকসই হবে না, বরং পরিবেশও সুরক্ষিত হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে জৈব সারের ব্যবহার মোট সারের মাত্র ৫-৬ শতাংশ। সরকার ২০২১ সাল থেকে জৈব সার উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিলেও মাঠ পর্যায়ে এর প্রভাব সীমিত। অন্যদিকে, শুধু ইউরিয়া সারের ভর্তুকিতেই প্রতিবছর সরকারের খরচ হয় প্রায় ১০-১২ হাজার কোটি টাকা। কৃষিবিদদের মতে, এর একটি অংশ যদি সবুজ সার প্রসারে ব্যবহার করা যায়, তাহলে খাদ্য উৎপাদনে বড় কোনো ক্ষতি না করেই খরচ কমানো সম্ভব হবে।

শুড়িখালীর অভিজ্ঞতা যদি বৃহৎ পরিসরে সম্প্রসারিত হয়, তাহলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে,রাসায়নিক সারের আমদানি নির্ভরতা হ্রাস পাবে, জমির উর্বরতা ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ত মাটিতেও উৎপাদন টেকসই হবে।
শুড়িখালীর কৃষক শাহাজাহান হোসেনের উদ্যোগ প্রমাণ করেছেন রাসায়নিক সার ছাড়াই ধান চাষ শুধু সম্ভব নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনকও। স্থানীয় কৃষকেরা ইতিমধ্যেই তার অনুপ্রেরণায় ধৈঞ্চা চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

এখন প্রয়োজন সরকারি সহায়তা, গবেষণা ও কৃষক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। তাহলেই রাসায়নিক সারের ব্যয়সাপেক্ষ চক্র থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষির পথে অগ্রসর হতে পারবে।