রাসেল আহমেদ, তেরখাদা(খুলনা): তেরখাদা উপজেলার বারাসাত ইউনিয়নের ইখড়ি গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। কয়েক বছর আগেও বিকেলের পড়ন্ত বেলায় এ গ্রামে শোনা যেত শিশু-কিশোরদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর কণ্ঠস্বর-‘ইচিং বিচিং চিচিং চা’, ‘প্রজাপতি উড়ে যা’, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ’, ‘যাকে পাবি তাকে ছোঁ’, কিংবা কেউ খেলত ‘গোল্লাছুট’, ‘কুতকুত’, ‘সাত ধাপ্পা’, ‘লুকোচুরি’। কিন্তু সময় বদলেছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে গেছে সেই চিত্র। এখন আর মাঠে দৌড়ঝাঁপ নেই, আছে কানে হেডফোন, হাতে স্মার্টফোন। সেই কিশোরদের মুখে এখন শোনা যায়, ‘সাইডে যা’, ‘রিভাইভ দে’, ‘হিল কর’, ‘স্মোক মার’। তারা এখন ঘরবন্দি হয়ে সময় কাটাচ্ছে অনলাইন গেমে-ফ্রি ফায়ার, পাবজি, কল অব ডিউটির মতো গেমসে। শুধু ইখড়ি গ্রাম নয়, একই অবস্থা উপজেলার অন্য গ্রামগুলোতেও। শিশু-কিশোরদের দীর্ঘ সময় ডিভাইসে আসক্ত থাকার কারণে বদলে যাচ্ছে তাদের স্বভাব ও আচরণ। অনেকেই দূরে সরে যাচ্ছে পড়াশোনা থেকে, এমনকি জড়িয়ে পড়ছে মাদকের মতো মারাত্মক আসক্তিতে। ফলে বাড়ছে অভিভাবকদের উদ্বেগ। এ বিষয়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের মতে, এই আসক্তির শুরু করোনাকালে-যখন স্কুল বন্ধ থাকায় অনলাইনে ক্লাস করতে হতো। সেই সময়ে শিশুদের হাতে স্মার্টফোন আসে। এখন সেটিই পরিণত হয়েছে নেশায়। বারাসাত গ্রামের এক অভিভাবক বাচ্চু বলেন, “আমার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে সকাল-বিকেল টাকা চায়। না দিলে খারাপ ব্যবহার করে। পরে জানতে পারি, সে মোবাইল গেমসে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ”সরকারি ইখড়ি কাটেংগা ফজলুল হক মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এক শিক্ষার্থী আগে খুব নিয়মিত ছিল। হঠাৎ করে অনিয়মিত হয়ে যায়। সহপাঠীদের কাছ থেকে জানতে পারি, সে গেমসে আসক্ত হয়ে ধূমপানেও জড়িয়ে পড়েছে। শাসন করলে সে উল্টো বেয়াদবি করে। অভিভাবকদের জানালেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি। আদমপুর বলর্দ্ধনা শালিকদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইকরাম হোসেন বলেন, “শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষার্থীদের মোবাইল গেমসের আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য শুধু শিক্ষক নয়, অভিভাবক ও সচেতন মহলকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার শাহেলা সুলতানা বলেন, “অভিভাবকরা সচেতন না হলে শিক্ষকদের একার পক্ষে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।” উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. পার্থ প্রতিম দেবনাথ বলেন, “অতিরিক্ত গেমস খেলার ফলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ঘুম কমে, খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা দেখা দেয়, ওজন কমে যায় এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এমনকি তাদের স্মৃতিশক্তিও লোপ পায় এবং একসময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, যা মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দেয়।”তিনি অভিভাবকদের আহ্বান জানান, শিশুদের মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রেখে তাদের মাঠের খেলাধুলায় ফেরানোর জন্য সচেষ্ট হতে।