খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভাইস-চ্যান্সেলর

প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন

* গৌরবের পদ্মা সেতু, আর বাকী ৬ দিন

এইচ এম আলাউদ্দিন :খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন বলেছেন, পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নানামুখী সম্ভবনার দ্বার উন্মোচন করবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের এই সাফল্য গাঁথা অনাগত কাল ধরে বাঙালি জাতির প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। আর মাত্র ছয়দিন পরই পদ্মা সেতুর দ্বার উম্মোচন হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ জুন এ সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের এই মাহেন্দ্রক্ষণ সম্পর্কে একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আপনার মূল্যায়ন কেমন জানতে চাইলে খুলনার অন্যতম এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বললেন, পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য নানামুখী সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। যা দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ, স্বাধীন ভূ-খ- এনে দিয়েছেন। আর তাঁরই রক্তের উত্তরাধিকারী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণে সদর্পে এগিয়ে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ সেই স্বপ্নেরই মাইলফলক।
পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা মনোভাবের বাস্তবচিত্র উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাঙালি জাতির গৌরব ও আত্মমর্যাদার পরিচয়। পদ্মা সেতু এখন আমাদের সক্ষমতার প্রতীক। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিলো অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দৃঢ় মনোবল, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা দিয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের। বাংলাদেশ যে ‘পারে’, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে তা কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বুকে আমরা মাথা উঁচু করে সগৌরবে বলতে পারছি যে, ‘আমরাও পারি’। এটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য সম্ভব হয়েছে বলেও জানান তিনি ।
পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কি ভূমিকা রাখবে এমনটি জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, আমরা খুব ভালো করে জানি যে, দীর্ঘদিন ধরে এই দক্ষিণাঞ্চল রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। আর শুধু এ কারণেই দক্ষিণাঞ্চলের এ বিশাল ভূ-খন্ড নানাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। খুলনা-সাতক্ষীরা-যশোর বা পটুয়াখালী-বরিশাল-বরগুনা যাতায়াতে ৮-১০ ঘণ্টা সময় লাগতো। অনেক সময় তার চেয়েও বেশি লাগতো। সেটি এখন মাত্র চার ঘণ্টায় সম্ভব হবে। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে এই অঞ্চল থেকে উৎপাদিত কৃষি পণ্য অতি সহজেই, অল্প সময়ে তা রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছে যাবে। ফলে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য পাবে এবং নানাভাবে উপকৃত হবে।
পদ্মা সেতু মংলা, বেনাপোল ও ভোমরা বন্দরে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যাপক শিল্পায়নের যে প্রক্রিয়া চলছে এবং এ বন্দরের উন্নয়নে যে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, এর ওপর পদ্মা সেতু সরাসরি প্রভাব রাখবে। বেনাপোল ও ভোমরা বন্দর কর্মচাঞ্চল্য হয়ে উঠবে। আমদানি-রপ্তানি বাড়বে।
পদ্মাসেতু চালু হলেও খুলনায় বিমান বন্দরের চাহিদা থাকবে উল্লেখ করে খুবি উপাচার্য বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন এবং মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কারণে দেশের ভৌগলিক কৌশলগত প্রতিরক্ষার দিক ছাড়াও জরুরি বা দ্রুততম সময়ে যাতায়াতের সুবিধার্থে এখানে বিমানবন্দর প্রয়োজন। বিমান বন্দর থাকলে খুলনা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, খুলনা-সিলেট, খুলনা-রাজশাহী-সৈয়দপুর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু হতে পারে। এছাড়াও এখানে বিদেশি পর্যটকরা আসবেন। তারা হয়তো ঢাকায় না নেমে সরাসরি খানজাহান আলী(রহ:) বিমানবন্দরে পৌঁছে মোংলা বা সুন্দরবন, বাগেরহাট ষাটগম্বুজ, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা বা সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ যেতে চাইবেন। আবার মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা দ্রুত সময়ে কাজ সেরে আসা-যাওয়ার জন্য এই বিমান বন্দর ব্যবহার করতে পারেন। এসব বিষয় মাথায় রেখে আমাদের বিমান বন্দরও চালু করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।
পদ্মাসেতু দেশের সার্বিক শিক্ষা উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে তার সবার জন্য কিন্তু নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। এখন আমরা ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। এই ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রয়োজনে আমাদের যে দক্ষ জনশক্তি দরকার তা গড়ার ভূমিকা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই নিতে হবে।
খুবি উপাচার্য আরও বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে এক সময় যে শিল্পায়নের গতি ছিলো, সেই গতি কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হারিয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে সেই গতি আবারও ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই অঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন হলে সেই শিল্পায়নের একটা ইতিবাচক প্রভাব নানা ক্ষেত্রে পড়বে। এছাড়া শিল্পায়ন হলে স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঘটবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অর্থনীতিবিদদের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, পদ্মা সেতু ১% থেকে ২% পর্যন্ত আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে। কিন্তু মনে হচ্ছে, এর চেয়ে আরও অনেক কিছু আছে যেটা আমরা এখনও অনুধাবন করতে পারছি না। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে দেশের উপকূলীয় এলাকা। যার জন্য আমরা মাতারবাড়িতে উন্নয়নগুলো দেখছি, তারপরে আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দর দেখছি এবং কক্সবাজার, মহেশখালী ও সন্দ্বীপ এখানে যে ধরনের উন্নয়ন দেখছি। সুতরাং তাতে বলতে পারি উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। সেই উন্নয়নের রোডম্যাপে আমরাও কিন্তু যুক্ত হয়েছি। পদ্মা সেতু আমাদের মোংলা বন্দর এবং এই অঞ্চলের শিল্পায়ন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলেও মনে করে তিনি।
পদ্মায় রেলসেতুও একটা ভালো দিক উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা থাকায় রেল দিয়ে ভারতসহ ট্রান্সএশিয়ান যোগাযোগ সাধিত হবে। দেশের অভ্যন্তরে ট্রেন চলাচল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হবে। তবে এই রেলের সাথে মোংলা বন্দরকে লিংক করতে পারলে আরও ভালো হয়। এ বিষয়টির প্রতি তিনি সরকারকে বিবেচনায় নেয়ার আহবান জানান।
পদ্মা সেতুর সাথে তাল মিলিয়ে এ অঞ্চলে আরও কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানিয়ে খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, পদ্মা সেতুর সাথে তাল মিলিয়ে বিশেষ করে শিল্প বিনিয়োগ, নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন ও ইকোট্যুরিজমের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং তার যে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য, তার যে ইকোলজিক্যাল সার্ভিসগুলো রয়েছে, সেজন্য পর্যটককে আহ্বান জানানোর পাশাপাশি যথাযথ পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অবকাঠামোগত এবং আইনগত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বন বিভাগ ও সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত বলেও তিনি মনে করেন। তবে ম্যাসট্যুরিজম না করে কনট্রোল ইকোট্যুরিজমের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এর ফলে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল যে জনগোষ্ঠী রয়েছে তারাও উপকৃত হবে বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া এ অঞ্চলে এখন পর্যটকদের থাকার জন্য উন্নতমানের হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট প্রয়োজন হবে। ভাঙ্গা থেকে কাটাখালী এবং কাটাখালী থেকে মোংলা, আবার অন্যদিকে কাটাখালী থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত সড়ক চার বা ছয় লেনে উন্নীত করা দরকার বলেও মনে করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
গৌরবের পদ্মা সেতু বিশ্ববাসীর জন্য বাংলাদেশের সক্ষমতার বার্তা বলেও উল্লেখ করেন। পরিশেষে তিনি দীর্ঘপ্রতিক্ষীত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।